Breaking News

‘কাটোয়ার যুদ্ধ’ ক্লাইভের সঙ্গে ইংরেজ বনিকদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল

 

অর্পণ নন্দী, কাটোয়াঃ ‘কাটোয়ার যুদ্ধ’ ক্লাইভের সঙ্গে ইংরেজ বনিকদের  ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। ষড়যন্ত্রের এই যুদ্ধ ইংরেজদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, কাটোয়ার যুদ্ধ যদি সত্যি সংঘটিত হত তাহলে হয়ত ভারতের ইংরেজ শাসনের ইতিহাস পালটে যেত। কিন্তু, সবকিছুকে ছাপিয়ে ভক্তিবাদের শহরে  ভারতের ভাগ্যের নির্মম ইতিহাস  লেখা হয়েছিল।  ষড়যন্ত্রের কথামত ১৮ জুন ক্লাইভ পাটুলি থেকে অগ্রদ্বীপ হয়ে মীরজাফরকে জানিয়ে আয়ারকুটকে সঙ্গে করে ১৯ জুন দুপুরে  কাটোয়া আসে। স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শাঁখাই দুর্গের কেল্লাদার কুতুবুদ্দিন কে আত্মসমর্পণ করতে ক্লাইভ  নির্দেশ দিয়েছিল। মেজর কিলপ্যাট্রিক ও ক্যাপ্টেন গ্রান্টকে নিয়ে ১৯ জুন দুপুরে  ক্লাইভ কাটোয়ার দুর্গ অবরোধ করে।

মীরজাফরের ‘ইঙ্গিতপূর্ণ নির্দেশের’ কথা দুর্গের কেল্লাদার থেকে সৈন্যরা সকলেই জানত। ইংরেজ সৈন্যদের দেখে কাটোয়া দুর্গের উত্তরের দরজা দিয়ে ফৌজিদার মুজফফর জং আত্মগোপন করলে ১০ হাজার সৈন্যের এক বছরের খাদ্যশস্য ইংরেজদের হাতে চলে আসে। যদিও এই ঘটনার ভিন্নমত পাওয়া যায়। প্রাবন্ধিক ইতিহাসবেত্তা কালীপ্রসন্ন শর্মার মতে দেশাত্মবোধে উদবুদ্ধ হয়ে অনেক সংখ্যক সৈন্য লড়াই জারি রেখেছিল। ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে সেদিন  লড়াই  হয়েছিল। নবীন চন্দ্র সেন যদিও তাঁর কাব্যচিন্তায় লিখেছেন, “অদূরে  কাটোয়া দুর্গে ব্রিটিশ কেতন // উড়িছে গৌরবে উপহাসিয়া ভাস্করে….।”

ক্লাইভের সিদ্ধান্তে সাঁখাই দুর্গ ও কাটোয়ার দুর্গ দখলের সময়   সঙ্গে  ছিল মেজর কিলপ্যাট্রিক, ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ও আয়ারকুট। ক্লাইভ ২০ জুন কাটোয়া থেকে অতি প্রত্যুষে  এক ঘোড় সওয়ারের মাধ্যমে  বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানকে সৈন্য সাহায্যের জন্য চিঠি লেখে।

পাশাপাশি ২১ জুন ফোর্ট উইলিয়মের সিলেক্ট কমিটির কাছে চিঠি দিয়ে  যুদ্ধের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। সিলেক্ট কমিটির নির্দেশ আসার আগেই ২২ জুন মধ্যরাতে ভাগীরথী পার করে ক্লাইভ সৈন্য   পলাশীর দিকে  রওনা দিল। ঘোড় সওয়ারের মাধ্যমে খবর পেয়ে  অগ্রদ্বীপের ইংরেজ  সৈন্যদল ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে বসতপুরের  ছাউনি ডাঙ্গায় টহল দিতে শুরু করে। এদিকে সিলেক্ট কমিটির নির্দেশ আসার আগেই  ক্লাইভ পলাশীর আমবাগানে যুদ্ধের সমস্ত রকম প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। আয়ারকুটের ভাষায় “সহজে” যুদ্ধ জয় করল ইংরেজ সৈন্যদল। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের কাউন্সিল থেকে ক্লাইভকে  নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল কাটোয়ায় অপেক্ষা করতে। অর্থাৎ  বর্ষায় পলাশী যুদ্ধের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল সিলেক্ট কমিটির। কাটোয়ায় নির্দেশ পৌঁছানোর  আগেই ক্লাইভ  পলাশীর আমবাগানে পৌঁচেছিল। ক্লাইভ যদি পলাশীর আমবাগানে না যেত তাহলে  হয়ত ভারতের ইতিহাসটা  অন্যরকমভাবে  লেখা হত। 

ওই ছুটে যায়  ইংরেজ সেনাপতির দল।   সূর্যের আলোকে পাশে রেখে  গঞ্জ থেকে  জনপদ মারিয়ে অনায়াসে বনানীকে হেলায় হারিয়ে দ্রুতময়তায় ছুটে যায় গর্বিত ঘোড় সওয়ারের দল। মাটি কাঁপিয়ে ঝড় তুলে উর্ধশ্বাসে ছোটে জয়ের নিশান নিয়ে। কখনও জলে  তো কখনও ডাঙ্গায়। পায়ের তলার মাটি, মাটির উপর গড়ে ওঠা দেশ দেশান্তরের  সবুজ তৃণভূমি তার অহংকৃত গতির বৈভবে পরাজয়ে ক্রমশ নীল হয়ে উঠেছে সারা বাংলা তথা দেশ। ঘোড়ার নিঃশ্বাসে রাজরক্তের আঘ্রাণ। পিছনে পড়ে থাকে  নবাবের পরাজিত  সৈন্যবাহিনী। অসহায়  অবস্থায় অনেকে  মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। নবাব সিরাজউদ্দোলার ভাগ্যনির্ধারণ হয়ে গিয়েছে। বাংলার বাতাস ক্রমশ ভারী হচ্ছে। গাঁ-গঞ্জের দিনযাপনের গ্লানি অতিক্রম করা মানুষগুলো প্রাণে  ভয় জাগিয়ে ঘরের অন্ধকারে অন্তরীন করে দিচ্ছে ইংরেজদের বুটের আওয়াজ । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পর বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে শুরু হল  পরাধীনতার শিকলে  বাঁধা জীবন। দেশের মানুষ  তার সর্বস্ব খোয়াতে শুরু করল। ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ যদি নবাবের  সৈন্যদের সঙ্গে  ষড়যন্ত্র না করত তাহলে হয়তো এই পরাধীনতার গ্লানি আমাদের মাখতে হত না। ভারতের ইতিহাস পাল্টে যেত।

১৭৫৭ সালের ১৯ জুন কাটোয়ার বাগানে পাড়ায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার দুর্গে হানা দেয় ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ। কাটোয়ার এই  সিংহ দরজার কাছে বসেই  পলাশী যুদ্ধের  ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। ইতিহাসের নথি থেকে জানা যায় ১৯ জুন রাতে কাটোয়ার “সিংহ দরজার” চৌকাঠে বসেই  ক্লাইভ নিজ সিদ্ধান্তে পলাশীর যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কাহিনি লিখেছিল। যদিও লোক দেখান কয়েক ঘন্টার যুদ্ধ একটা হয়েছিল শর্তানুসারে, লর্ড ক্লাইভের সৈন্যে দলের  সঙ্গে  মীরজাফর অনুগত দুর্গের ফৌজদার ‘মুজফফর জংয়ের।’ যুদ্ধে যথারীতি নবাবের সৈন্যরা বশ্যতা স্বীকার করে নেন। যদিও ক্যাপ্টেন আয়ারকুটকে সঙ্গে করে  লর্ড ক্লাইভ  কাটোয়ার দুর্গের আগে পাটুলি ও শাঁখাইয়ের দুর্গেরও  দখল নিয়েছিল। মীরজাফরের সঙ্গে যোগসাজশ করেই সমস্ত কাজ হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় ক্লাইভের সৈন্য সংখ্যা ছিল মোট ৭০০, এর মধ্যে ৫০০ দেশি সৈন্য ২০০ গোরা সৈন্য। এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যের  সঙ্গে মোকাবিলা মুর্খামি হবে জেনেই কৌশলে ষড়যন্ত্র করে ক্লাইভ কাটোয়ার দুর্গের সৈন্যসহ  খাদ্য ভাণ্ডার নিজেদের হেফাজতে করে   থেকেই ২১জুন ভাগীরথী দিয়ে ১৩ মাইল দূরে পলাশীর আমবাগানে পৌছায় সসৈন্য লর্ড ক্লাইভ। ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে লর্ড ক্লাইভ কয়েকবার মীরজাফরের সঙ্গে প্রত্রালাপ করেছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইতিহাস সম্পৃক্ত কাটোয়ার সেই সিংহ দরজা এখন কালের  কবলে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এই সিংহ দরজা নিচ থেকে একটি সুরঙ্গ সরাসরি ভাগীরথীর সঙ্গে যোগ করা ছিল। দুর্গ থেকে নবাব বা নবাবের সৈন্যদের যাতায়াতের গোপনপথ ছিল এই সুরঙ্গ। বর্তমানে সুরঙ্গ বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্গে সহসা শত্রুপক্ষ হামলা বা আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য দুর্গের চারদিকে পরিখা ছিল। সেই পরিখা বুজিয়ে এখন সাধারণের যাতায়াতের পথ হয়েছে।আদতে এই সিংহ দরজা হল  মসজিদের প্রবেশ পথের তোরণ।  সিংহ দরজার মাথায় খোদিত লিপি থেকে জানা যায় এই তোরণ ১৬৩৭ শকাব্দে অর্থাৎ ১৭১৫ সালে মুসলমান সাধক ফকির শাহ আলমের হুজরা কক্ষ  বা  প্রার্থনা কক্ষে যাওয়ার প্রধান প্রবেশ পথ ছিল।  পরে মুর্শিদকুলি খাঁ এই শাহ আলমের দরগায়  ফৌজদারদের চৌকি করেন। সেই থেকেই নবাবের দুর্গ হিসাবেই পরিচিত ছিল এই শাহ আলমের দরগা। মুর্শিদাবাদের প্রবেশপথে ছিল এই দুর্গের অবস্থান। সে কারণে  কাটোয়ার দুর্গের অসীম  গুরুত্ব ছিল, শোনা যায় সিরাজদ্দৌলা কয়েক রাত এই দুর্গে কাটিয়েছিলেন। সে দিন যদি লর্ড ক্লাইভ ষড়যন্ত্র করে নবাবের সৈন্যদের হাত না করত তাহলে হয়ত  ভারতের ইতিহাস অন্যরকম লেখা হত। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য  ডোবার সাক্ষ্য বহন করে কাটোয়ার পবিত্র গঙ্গা। চৈতন্যের দীক্ষাভূমে মীরজাফরের জঘন্য চক্রান্তের শিকার হল  ভারতবাসী। দেশ পরাধীন হল। ইতিহাসের সেই সব ঘটনার ঘনঘটা আজও জাগর কাটোয়ার “সিংহ দরজার” খিলানের পাথরে। ভারতের পরাধীনতার  ইতিহাসের শুরুর ষড়যন্ত্রের কাহিনি খিলানের পাঁচিলে  লিপিবদ্ধ আছে।  যা সাদা চোখে পরখ করা যায় না শুধুই অনুভূত হয়। ভারতের ইতিহাসের এই উজ্জ্বল সাক্ষীকে   রক্ষা করার তাগিদ  শহরবাসীর নেই বললেই চলে।  

About Burdwan Today

Check Also

সম্পত্তিগত বিবাদের জেরে ভয়ঙ্কর কাণ্ড, দাদাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে খুন

দেবনাথ মোদক, বাঁকুড়াঃ সম্পত্তিগত বিবাদের জেরে দাদাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠল ভাইয়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *