উপস্থাপন : দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য
ভারতবর্ষের বহু ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কহীনতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রে বিশেষ ভাষা-ধর্ম ও জাতির প্রতি পক্ষপাত নিজেদের মধ্যে অনতিক্রম্য এক দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। যেন মানুষকে একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি ও একটি ধর্ম দিয়ে আত্রান্ত করে ফেলতে চাইছে জাতীয়তাবাদের প্ররোচনায়। তবু বহু মানুষ , কবি সাহিত্যিক চেষ্টা আজও করে যাচ্ছেন কেবলমাত্র ভাবনার নিরিখে বিভিন্নতায় একতা আনার।
আধুনিক সাহিত্য মৌখিক-সাহিত্যকে (ওরাল লিটারেচার) গ্রাম্যতা বলে বিদায় করেছে ভারতচন্দ্রের পর থেকেই, এবং যেটুকু বেঁচে আছে তা ফাইন এবং ফোক আর্টের পার্থক্য সৃষ্টির মাধ্যমে; ফলে তৈরি হয়েছে ‘অপর’ ভাষা; যা আমাদের নয়– তো এই বিদ্বৎসমাজের সামনে হলধর নাগ চারণ-কবি হিসেবেই গৃহীত হয়ে থাকবেন বলে আশা করা যায়।
আজ হলধর নাগের সাহিত্য কর্ম নিয়ে পি এইচ ডি করা আমাদের মনে করিয়ে দেয় হলধর নাগ যে ভাষায় কবিতা লিখছেন, অর্থাৎ উড়িয়া রাজ্যের ‘কোশালি’ ভাষা, যে ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য চার দশক ধরে সংগ্রাম করছেন এই ভাষাই মানুষ– উনিশ শতকের আগে যার লিখিত রূপও ছিলো না, এখন একজন হলধর নাগ এই ভাষাকে মহাকাব্যিকতা দিয়েছেন, এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার আবেদনকে উচ্চকিত করে তুললেন।
|| জীবনী ||
কবি হলধর নাগ ২০১৬ সালে ভারতের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছেন। ততকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তিনি পদক গ্রহণ করেছেন। পদ্মশ্রী পাওয়ার আগে পর্যন্ত ওডিশা রাজ্যের বাইরে তাঁর পরিচিতি কম ছিল। একদিনেই সেই পরিচিতি জগতজুড়ে ছড়িয়ে গেল।
লোক কবি হলধর নাগ শুধু কবিই নন, তার আরেকটি বিশেষ প্রতিভা শুনলে অবাক হতে হয়। কবি যত কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন, পুরোটাই তার মুখস্থ! কেউ যদি কোনো কবিতার নাম, চরিত্র বা দু-এক চরণ উল্লেখ করে তাকে ওই কবিতা বলতে বলেন, তাহলে না দেখেই পুরো কবিতা বলে দিতে পারেন তিনি। বিশ্বে অনেক কবি, মহাকবির নাম শুনেছি আমরা, কিন্তু এমন চারণ কবির নাম শোনা যায়না, যিনি নিজের লেখা প্রতিটি কবিতা এমন কি পুরো কাব্যগ্রন্থ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারেন। এই জন্য তাঁকে ‘অলৌকিক’ কবিও বলা যায়।
ভারতের ওডিশা রাজ্যের বারগড় জেলার ঘেনসে গ্রামে ১৯৫০ সালের ৩১ মার্চ এক গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হলধর নাগ। মাত্র ১০ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবা মারা যান। তারপর তার আর স্কুল যাওয়া হয়নি । সংসারের হাল ধরেন সেই অল্প বয়সে। হোটেলে হাড়িপাতিল পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। সে সময় মাকে নিয়ে খুব কষ্টে কাটে তাদের জীবন। হলধর নাগ তার সেই সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে বলেছেন, ‘একজন বিধবার ছেলের জীবন কঠিনই হয়।’
এক গ্রামপ্রধান হলধর নাগকে একটি স্কুলে বাবুর্চির কাজ দেন। সেখানে থাকেন ১৫ বছর। এর মধ্যে আশেপাশে আরো কিছু স্কুল গড়ে ওঠে। এক ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে ১ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজেই একটি দোকান দেন। কষ্টের দিন দূর হতে শুরু করে তার। এর মধ্যে বিয়েও করেন।
দিন আনা দিন খাওয়া হলধর নাগ স্কুলে বাবুর্চির কাজ করার সময় আপন খেয়ালে কবিতা লেখা শুরু করেন। স্থানীয় একটি সাময়িকীতে তিনি চারটি কবিতা পাঠান। ধারাবাহিকভাবে চারটি কবিতাই ছাপা হয়। তার প্রথম কবিতা ‘বুড়ো অশ্বথ গাছ’। হলধরের কবি প্রতিভার সমাদরও করে ওই সাময়িকী। কিছু সম্মানী দিয়ে তাকে লেখায় উৎসাহিত করা হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
হলধর নাগের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে ওড়িশার আনাচে-কানাচে। প্রতিবেশী রাজ্য ছত্তিশগড়েও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
পদ্মশ্রী ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক। সম্মানের এ পদক হলধর নাগকে দেওয়া হলেও তিনি যে ভাষায় কাব্য সাধনা করেন, তা ওড়িশার সরকারি ভাষা নয়। ওড়িশা রাজ্যের পশ্চিম ওডিশা অঞ্চলের মানুষের ভাষা কোসলি। উড়িয়া ভাষার রূপভেদ কোসলি, যাকে উড়িয়া ভাষায় ‘কোসালি’ বলা হয়। কোসলি ভাষাকে স্থানীয়ভাবে সম্বলপুরি ভাষাও বলা হয়। ১৯ শতকের আগে কোসলি ভাষার কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায় না। কিন্তু বহু আগে থেকে এ ভাষা পশ্চিম ওড়িশার মানুষের মুখের ভাষা ছিল। ওড়িশা রাজ্যে সরকারি ভাষা হিসেবে কোসলির স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন চলছে গত চার দশক ধরে। কবি হলধর নাগ আন্দোলনকারীদের একজন এবং বর্তমানে আন্দোলনের প্রথম সারির উচ্চকণ্ঠ। হলধর নাগের স্ত্রী মালতি নাগ। তাদের এক মেয়ে। হিন্দু ধর্মানুসারী তিনি। সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত হলধর নাগ ধুতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরেন না। সব সময় খালি পায়ে থাকেন।
শব্দের পরে শব্দজুড়ে তিনি লিখে যান গরিবের সুখ- দুঃখের কাব্য। সাধারণ শব্দও তার কবিতায় অসাধরণ হয়ে ওঠে প্রয়োগের সুচিন্তায়। তাই তো তিনি লোকের মাঝে থেকেও অলৌকিক।
Social