ফারুক আহমেদঃ বিগত প্রায় এক বছর যাবৎ লক্ষ করে আসছি বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন শক্তিমান ও জনপ্রিয় কবি-গবেষকের সরব ও প্রবল উপস্থিতি। তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম। জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩ বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। আমি সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য পত্রিকা, গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকায় এবং দুই বাংলা কবি-কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে তাঁর সম্পর্কে একটা মোটামুট পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গেছি অল্প সময়েই। কবি-প্রাবন্ধিক হিসাবে আমিনুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ নব্বই দশকে। লেখার বিষয়: কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া এবং সংগীত বিষয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। এযাবৎ তাঁর দুই ডজনের অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ: তন্ত্র থেকে দূরে-(২০০২); মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম-(২০০৪); শেষ হেমন্তের জোছনা–(২০০৮); কুয়াশার বর্ণমালা (২০০৯); পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি-(২০১০); স্বপ্নের হালখাতা–(২০১১); প্রেমসমগ্র-(২০১১); জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার-(২০১২); শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ-(২০১৩); কবিতাসমগ্র-(২০১৩); জোছনার রাত বেদনার বেহালা-(২০১৪); তোমার ভালোবাসা আমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট-( ২০১৫) প্রণয়ী নদীর কাছে-(২০১৬), ভালোবাসার ভূগোলে-(২০১৭); নির্বাচিত কবিতা-(২০১৭); অভিবাসী ভালোবাসা-(২০১৮), জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র- (২০১৯); বাছাই কবিতা-( ২০১৯); প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ-(২০২০); হিজলের সার্কিট-(২০২১); রমনার কোকিল-(২০২২); মহানন্দা থেকে মধুমতী-(২০২৩); (খ) ছড়ার বই: ১.দাদুর বাড়ি-(২০০৮); ২. ফাগুন এলো শহরে-(২০১২); ৩. রেলের গাড়ি লিচুর দেশ-(২০১৫)। (গ) প্রবন্ধগ্রন্থ: বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ-(২০০৯); (ঘ) গবেষণাগ্রন্থ: নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব (২০২১)।
উল্লেখ্য, আমিনুল ইসলামের সঙ্গে আমার আজও দেখা হয়নি। আমি আমার ‘উদার আকাশ’ পত্রিকায় তাঁর কবিতার ওপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ছেপেছি। তাঁর লেখা কবিতা ছেপেছি। কাজী নজরুল ইসলামের ওপর তাঁর লেখা একটি অসাধারণ সমৃদ্ধ প্রবন্ধ ছেপেছি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ একটি গ্রন্থে। যত দিন যাচ্ছে আমি বিস্মিত হচ্ছি তাঁর লেখা কবিতা, নিবন্ধ ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের অসাধারণভাবে উন্নত মান দেখে। তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছেন এবং সেই ধারা অব্যাহত আছে মর্মে চোখে পড়ছে। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ এবং বেশ কয়েকটি ছোট কাগজ তাঁর ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সৃজনশীলতায় ও মননশীলতায় অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইতিমধ্যে (১) বগুড়া লেখক চক্র স্বীকৃতি পুরস্কার ২০১০, (২) নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সম্মাননা ২০১৩, (৩) এবং মানুষ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭, (৪) দাগ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮, (৫) কবিকুঞ্জ পদক ২০২১, (৬) পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পুরস্কার ২০২১, (৭) আইএফআইসি ব্যাঙ্ক সাহিত্য পুরস্কার ২০২১, (৮) বিন্দু বিসর্গ পদক ২০২৩, (৯) গ্রেস কটেজ নজরুল সম্মান-২০২৩ ইত্যাদি অর্জন করেছেন।
আমিনুল ইসলাম রচিত বেশ কয়েকটি বই আমার হাতে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে রচিত তাঁর ‘নজরুল সংগীত: বাণীর বৈভব’ একটি অসাধারণ গ্রন্থ। এই বইটির জন্য তিনি বাংলাদেশের ‘আইএফআইসি ব্যাঙ্ক সাহিত্য পুরস্কার ২০২১’ এবং ভারতের নদিয়া থেকে ‘গ্রেস কটেজ নজরুল সম্মান ২০২৩’ লাভ করেছেন। তবে তাঁর মূল পরিচয় কবি হিসেবে। তাঁর কবিতার বইয়ের সংখ্যা দুই ডজনের কাছাকাছি। তিনি জন্মসূত্রে বাঙালি কিন্তু মন-মানসিকতায় বিশ্বনাগরিক। তাঁর কবিতায় স্থানীয় মানচিত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভূগোল এবং সমসাময়িকতার সঙ্গে অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের কল্পনা একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। যুগপৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের নিবিড় অনুরাগী হওয়ায় সকল ধর্মের ও সকল দেশের মানুষকে সমভাবে আত্মীয়জ্ঞানে দেখা তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যদর্শনের অন্যতম প্রধান দিক। তাঁর কবিতায় বেহুলা-লখিন্দর, মধুমালা, নেফারতিতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গ্যেটে, কীটস, রুমি , হাফিজ, খৈয়াম, কালীদাস প্রভৃতি নাম এসেছে নতুন সৃষ্টির ব্যঞ্জনায়। অতীত এসেছে হয়ে বর্তমান, কাল মিলেছে গিয়েছে মহাকালে। অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ‘উদার আকাশ বইমেলা ২০২৪ সংখ্যা’-তে প্রকাশিত তাঁর ‘বহুকৌণিক অভীপ্সায় আমিনুল ইসলামের কবিতা’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন: ‘‘আমিনুল ইসলাম মনেপ্রাণে যুগপৎ স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাকিতাকে ধারণ করেন। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। পাঠক হিসেবেও তিনি বিশ্বচারী। সেজন্য তাঁর কবিতার মধ্যে একটি বৈশ্বিক ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তিনি বাংলাদেশের মানুষ বটে, কিন্তু তিনি একইসঙ্গে মনের দিক থেকে বিশ্বনাগরিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঐকতান’ শীর্ষক কবিতায় বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি/আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’ আমিনুল ইসলামের কবিতার মধ্যেও তার আন্তঃভূগোল চেতনা ও বিশ্বমানবের জন্য উদার ভালোবাসার টান লক্ষ করা যায়। তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন যেগুলোর মাঝে স্বদেশের ভূগোল ও বৈশ্বিক ভূগোল একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। তাঁর তেমন কিছু কবিতা হচ্ছে: ‘ব্লু মাউন্টেনে দাঁড়িয়ে’, ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’, ‘সাবিহা তোমার কাছে’, ‘ইস্তাম্বুলের ই-মেইল’, ‘ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া’, ‘পিছিয়ে যাওয়া মানুষ’, ‘আঁধারের জানালায়’, ‘তোমাকে দেখার সাধ’, ‘নেফারতিতির সঙ্গে’, ‘অভিবাসী চিরদিন’, ‘বিশ্বায়িত গ্রাম’, ‘ভালোবাসা কোনো সুবিধাবাদী রাজনীতি নয়’, ‘আমাদের ভালোবাসার দিন’, ‘ভালোবাসার নৌকো’, ‘একাকী অবররণ্যে’, ‘আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসব কেন?’ প্রভৃতি।” আমি ড. শামসুল আলমের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমিনুল ইসলামের কবিতা থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি:
ভালোবাসা এমনই হয়! এই নিয়ে আজও বহু বিতর্ক।
থাক্ না বিতর্ক; সে তো বিভেদকামীদের মণ্ডূকমনের
জল ঘোলা করার কুয়ো; ভালোবাসা খোঁজে ঐক্যের আকাশ;
তাই বিতর্কের ঝড়েও সে বন্ধ করে না অন্তঃভৌগোলিক
ডানা। আমার ডানায় মিশে আছে তোমার ডানার ছন্দ
আর বুকে যে উষ্ণতা— তারও কোনো জাত-ভূগোল নেই;
যদি কান পাততে—আমার ফুসফুসের স্রোতেলা বাণী
উম্মে কুলসুমের গান হয়ে মাতিয়ে দিত তোমার রক্ত।
(ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া)
আমিনুল ইসলাম প্রচুর সংখ্যক প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো গতানুগতিক নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের ভেতর দিয়ে মহাজীবন ও মহাবিশ্বকে দেখেছেন। আমিনুল ইসলাম প্রেমের ভেতর দিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন এবং প্রেমের কবিতায় তা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর প্রেমের কবিতায় জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, উপনিবেশবাদ বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন বিরোধিতা, সংগীত, মহাকর্ষ, অভিকর্ষ প্রভৃতি একাকার হয়ে অভিনব এক প্রেমচেতনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর প্রেমচেতনার মাঝে প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের প্রতি ভালোবাসা মিশে আছে। প্রখ্যাত গবেষকও প্রাবিন্ধক সরকার আবদুল মান্নান বলেছেন,‘‘প্রেমের কবিতার একটি প্রথাগত রূপৈশ্বর্য ও বিষয় বৈভবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। বিচিত্র অনুষঙ্গে মানব-মানবীর লীলালাস্যই সেখানে মুখ্য। আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের এই প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবনপ্রেমিকের বিস্ময়কর অন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়–বরং এসবকিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন-তৃষ্ণা। প্রচন্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনার অবয়বে। ফলে পালটে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবিভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে ওঠে আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র এক গঠনসৌষ্ঠব। জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি। ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তার কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায় আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র— আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান। অধিকন্তু তাঁর প্রেমের কবিতার সঙ্গে এত সব জাগতিক ভাবনা জড়িয়ে থাকে যে নিখাঁদ প্রেমবোধ অনেক সময়ই ব্যাহত হয়। প্রেমের কবিতার এই ভিন্নতাই আমিনুল ইসলামের কবিতার স্বাতন্ত্র্য।” (সূত্র: পূর্বোক্ত প্রবন্ধ)।
আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্যতম দিক হচ্ছে কবিতার বহিরঙ্গের গঠনে ও অন্তরস্থ শৈল্পিকতায় বৈচিত্র্য আনয়নের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত সফল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা তিনি প্রায়শ ফেসবুকে নিজ টাইমলাইনে শেয়ার করে থাকেন। তাঁকে মাঝে মাঝে স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করতেও দেখা যায়। বিষয়বৈচিত্র্য ও প্রকরণ অন্বেষা উভয় বিবেচনাতেই তিনি একজন অত্যন্ত শক্তিমান ও সফল কবি। তাঁর অনেক কবিতার মাঝে ম্যাজিক লাইন বা জাদুচরণ দেখতে পাওয়া যায়। এটা তাঁর কাব্যশক্তির অন্যতম উজ্জ্বল দিক। ‘মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে’, ‘গণিতের গাছে হিসাবে হলুদ পাতা’, ‘হৃদয় ছড়িয়ে আছে আসমুদ্র সে অব্যয়ীভাব’, ‘নৈকট্য আর দূরত্ব চুমু খায় পরস্পরের গালে’, ‘গরিবের ঘামে রোদ লেগে চিক চিক করছে ভ্যাট’, ‘ভালোবাসা খোঁজে ঐক্যের আকাশ’, ‘সাংবাদিক হয়ে ঘিরে ধরে কষ্ট’, ‘তথাপি প্রাণের ঘাঁটি এ আমার লখিন্দর-কায়া/ বেহুলা-দুপুর তুমি অক্সিজেনে মেখে ধূপছায়া’, ‘আমি কবি—উটের থলিতে আমার তৃষ্ণার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’, ‘আমি কবি—ভালোবাসা আমার বদভ্যাস’, ‘আমাকে জাগিয়ে রাখে শ্রাবণের অন্ধ পূর্ণিমা’ প্রভৃতি পঙ্ক্তি কবি হিসেবে তাঁর অনন্য শক্তিমত্তার স্মারক। তিনি শব্দের ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্প রচনায় অনন্য প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। একটা উদাহরণ:
‘মাননীয় অর্থমন্ত্রী,-রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়,
দেখুন-
গরিবের ঘামে রোদ লেগে চকচক করছে ভ্যাট,
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাগটানা পথ ধরে
দিনদিন বেড়ে চলেছে করের পরিসীমা;
বাড়ুক! শুধু এটুকু মিনতি—
দয়া করে আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না!
রাতরঙা ব্যাগহাতে এক্সটার্নাল অডিট যাক্ মেগা প্রজেক্টের বাড়ি!
(চুম্বন নিয়ে লেখা যে কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক)
আমিনুল ইসলাম সহজাত কবিত্বশক্তির কবি। অক্ষমের কষ্টকল্পনা নেই তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতার ভাষা সচ্ছল নদীস্রোতের মতো সাবলীল। তিনি সহজ ভঙ্গিতে গভীর কথা বলেছেন। কিন্তু চিত্রকল্প ও উপমার অভিনবত্ব তাঁর সহজ কবিতায় একধরনের আড়াল রচনা করেছে। অনেক কবিতাতে তিনি গল্পের বুনন সৃষ্টি করেছেন। সেই পুরনো গল্পের আড়ালে থেকেছে বর্তমান সয়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ বা প্রপঞ্চ। তিনি সহজ ভঙ্গিতে রহস্যময়তার আলো-আঁধারি রচনার দক্ষ কারিগর।
‘হায় প্রভু, তোমার কমলালেবুর ঝাঁপিহীন ঝুড়িতে
বিস্ময়ের আর কত মারবেল লুকিয়ে রেখেছো
ভালোবাসায় মুগ্ধ হতে ভালোবাসার প্রতিভাকে
বারবার লাল-নীল বিহ্বলতায় ভরে দেয়ার ভাবনায়!
প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকের সাজ পরে তার কাছে যাই
আর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি:
উদার স্তনের নিচে মুখ দিয়ে শুয়ে আছি আমি দুধের শিশু!’
(সে এক অদ্ভুত ব্যর্থতা)
আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে বহু কবি-অধ্যাপক-গবেষক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর কবিতা নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে বাংলাদেশে। তাঁর কবিতার একেক দিককে হাইলাইট করে একেকজন লিখেছেন। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তাঁর কবিতায় সৃষ্ট ভালো লাগার ঐশ্বর্য। তাঁর কবিতা পড়ামাত্রই ভালো লাগে। এবং সেই ভালো লাগা ফুরিয়ে যায় না। কবিতার অর্থ অথবা বক্তব্যবিষয় সম্পর্কে ভাবার আগেই উপমা-চিত্রকল্প-শব্দের অভিনব ব্যবহার ইত্যাদি সহযোগে সৃষ্ট সম্মোহন মনে গভীর ভালো লাগার অনুভূতির জন্ম দেয়। তিনি প্রায়শ ফেসবুক টাইমলাইনে কবিতা পোস্ট করে থাকেন। তাঁর টাইমলাইনে পড়া ‘একাকী, অরণ্যে’ নামক কবিতা একটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়।
হেকিমী দাওয়াই—অন্যথা তার নেই
লখার বাসর রচেছি শপথে এঁটে
বায়ু ছাড়া আর অনুমতি কারো নেই
দুঃখের প্রহরী দাঁড়িয়ে বাহির গেটে।
সাঁঝের আকাশে এখনো কি ফোটে তারা?
রাতের নদীতে এখনো কি জাগে ঢেউ?
খোলা বাতায়ন এখনো কি চায় সাড়া?
আমাকে পোড়াতে এখনো কি পোড়ে কেউ?
বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কবি-গবেষক হচ্ছেন অসীম সাহা। অসীম সাহার একটি প্রবন্ধের নাম ‘অভিভূত রূপকের কবি আমিনুল ইসলাম’। (দৈনিক যুগান্তর, ঢাকা, ২৫ অক্টোবর ২০১৯) সেই প্রবন্ধে প্রদত্ত তাঁর অভিমত দিয়ে আজকের মতো আমিনুল ইসলামের ওপর লেখার সমাপ্তি টানছি। তিনি বলেছেন: “বস্তুত শুধু প্রেমের নয়, আমিনুল ইসলামের সব ধরনের কবিতাতেই নতুনত্বের এই চমক পাঠকহৃদয়কে কখনও কখনও শিহরিত করে তুলবে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, তার উপমা ব্যবহারের কৌশল ও দক্ষতা। অবকজেকটিভ বিষয়কে সাবজেকটিভ করে তোলার সুনিপুণ কারিগর আমিনুল ইসলাম। একই সঙ্গে আধুনিকতার সব শর্ত পূরণ করেই বিশেষণকে বিশেষে পরিণত করে তিনি যখন তার কবিতাকে এক ধরনের নতুনত্ব দান করেন, তখন প্রচলিত কবিতার সকল অনুরাগকে ছাপিয়ে ভূগোলের অদৃশ্য দরজা উন্মোচিত হয়ে এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হওয়া ছাড়া পাঠকের আর উপায় থাকে না।”
Social