Breaking News

কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের উৎস অনুসন্ধান

সুব্রত দত্তঃ লড়াই লড়াই! দলে দলে লোক ছুটছে কাটোয়া। পথে আলপথে লোকের লাইন। ৬০/৬৫ বছর আগের কথা। গ্রামে তখন মধ্য যুগ। কুঁড়ে ঘর, রাস্তায় এক হাঁটু কাদা,ঘুঁটঘুটে অন্ধকার রাত। বৈচিত্র্যহীন বিনোদনে দমবন্ধ জীবন। হাঁফ ছাড়তে মানুষ মাঝে মধ্যে কাটোয়া ছোটে। কখনও গঙ্গা স্নানের নামে, কখনও বাজার হাট করতে। বাস ট্রেন দেখে ‘গেঁয়ো ভূত’।কেউ কেউ সিনেমা দেখে ‘পূর্বাচল’ হলে। গ্রামে এসে গর্ব করে,গল্প করে। হাঁ করে শোনে সবাই। আমাদের দুর্গাগ্রাম থেকে কাটোয়া মোটে পাঁচ ক্রোশ পথ। কিন্ত পথের কড়ি জুটত না সবার। কিন্তু কার্তিক পূজা এলেই যেন বাঁধ ভেঙে যেত। বিসর্জনের দিন লড়াই। সেদিন দলে দলে কাটোয়া ছুটত মানুষ। বেশিরভাগ হতদরিদ্র। বছরের জমানো সম্বল খুঁটে বেঁধে, এক পোঁটলা মুড়ি হাতে ছুটত। কারো সঙ্গে বেটা বিটি বউ। দুপুর থেকেই কাটোয়া লোকারণ্য। নদীয়া বীরভূম মুর্শিদাবাদ থেকেও এসেছে মানুষ। বিকাল থেকেই শুরু বিসর্জনের শোভাযাত্রা। সঙ্গে আলোর রোশনাই, বাহারী বাজনা। থাকে থাকে সাজানো ঠাকুরের থাকা। নানান পৌরাণিক কাহিনী দৃশ্য রূপে সজ্জিত। কোথাও রাম রাবনের যুদ্ধ, কোথাও কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ। তবে থাকার মধ্যমনি কার্তিক। কত কেতার কার্তিক! ল্যাংটা কার্তিক, খোকা কার্তিক, সাহেব কার্তিক, ধুমো কার্তিক, সাত ভাই কার্তিক ইত্যাদি।পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে প্রতিযোগিতা বা লড়াই।আপনজন, ঝঙ্কার,জনকল্যাণ সঙ্ঘ,জয়শ্রী সঙ্ঘ,ইত্যাদি কত ক্লাব। এখন কাটোয়া ছাড়িয়ে গেছে লড়াই। থাকার বদলে এসেছে থিম। আধুনিক আলো প্যান্ডেল যেন কলকাতার। আগে এই প্রতিযোগিতা ছিল বাবুদের। অর্থ প্রতিপত্তির লড়াই। গ্রামের প্রবীন মানুষের মুখে শুনেছি, কাটোয়ার নিচু বাজারের সঙ্কীর্ন পথে একাধিক শোভাযাত্রা মুখোমুখি হলেই সংঘর্ষ বাঁধতো। কে আগে যাবে,কে পিছে,কার ঠাকুর আগে বিসর্জন হবে,কারণে অকারণে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের লড়াই। এজন্য লাঠি তরোয়াল থাকত দলে, জোর প্রস্তুতিও থাকত। সেই লড়াই উপভোগ করত অগনিত লোক। দর্শনার্থীদেরও লড়াই কম ছিল না। সঙ্কীর্ন পথে মদমত্ত মানুষ ঠেলাঠেলি মারামারি করত। চরম অব্যবস্থা বিশৃঙ্খলা। ছিনতাই, মহিলাদের শ্লীলতাহানি, খুনোখুনিও ঘটেছে অনেক। গ্রামের মানুষ দিশে হারা হয়ে ছুটত তখন। সঙ্গের লোক হারিয়ে যেত। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরত অনেকেই। পরে কেউ ফিরত,কেউ ফিরত না। এ নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে গ্রামে।

       বিগত সাতের দশক পর্যন্ত কার্তিক লড়াইয়ের মূল কেন্দ্র ছিল কাটোয়ার নিচু বাজার বা বড় বাজার। কাটোয়া শহরের পত্তন ওখানেই। প্রথমে ছিল এক গঞ্জ ও বৈষ্ণব তীর্থ ক্ষেত্র। এখানেই নবদ্বীপের নিমাই কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে শ্রী চৈতন্য হন। নবাব মুর্শিদকুলি খান এখানে একটি ফৌজদারী চৌকি স্থাপন করেন ও এই গঞ্জের নাম দেন মুর্শিদগঞ্জ। তখনও বাণিজ্য কেন্দ্র হয়নি কাটোয়া।তখন দাঁইহাট ছিল এই এলাকার প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র। তার অনেক প্রমাণ আছে। 'বারো হাট তের ঘাট, এই নিয়ে দাঁইহাট' প্রবাদ প্রমাণ করে দাঁইহাটের গুরুত্ব। বর্গী সেনাপতি ভাষ্কর পণ্ডিত দুর্গা পূজা করেছিলেন এখানেই। বর্ধমানের রাজাদের গঙ্গানিবাশ থেকে অন্তিম সংস্কারের স্থান ছিল এখানেই। অনেক প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধান মিলেছে এখানে।জৈনদের নৈপজ্জি, বৌদ্ধদের মারীচি মূর্তি মিলেছে এখানে। কাটোয়ার সে গর্ব নেই। যখন বর্গী হামলা, অত্যাচার লুঠপাটে দাঁইহাট ছারখার হয়ে গেল। যখন দাঁইহাটের গা থেকে গঙ্গা সরে গেল অনেক দূরে, তখনই দাঁইহাটের স্থান নিল কাটোয়া। অজয়ের ওপারে শাঁখাইএ নবাবের একটি দুর্গ থাকায় কাটোয়া বা মুর্শিদগঞ্জ ছিল অনেক নিরাপদ।  

          কাটোয়া থেকে লবণ বস্ত্র কৃষি ও নানান পণ্যের আদান প্রদান শুরু হল। দ্রুত বৃদ্ধি হল জনপদ। পণ্যের কারবারীরা পাকা কোঠা গড়লেন গঙ্গার ধারে। এখনও সেই সব কোঠার কিছু চিহ্ন আছে। কাঁচা টাকার মালিকদের স্ফূর্তির জন্য গড়ে উঠল গনিকালয়। নাচে গানে জমে উঠত রাতের আসর। 

দেশান্তরের বণিকরাও বিশ্রামের অবকাশে টাকা উড়িয়ে যেত এখানে। নারীর চির কালের স্বপ্ন স্বামী সংসার সন্তান। গনিকারাও নারী। তাদের পঙ্কমুক্তির স্বপ্ন জমা থাকত পরকালের জন্য। এ জন্যই হয়ত কাটোয়ার গনিকারা কার্তিক পূজা শুরু করেছিল। ছোট্ট শিশু বা খোকা বা ল্যাংটা কার্তিক ছিল তাদের আরাধ্য। হয়ত সেই গনিকাদের পূজায় প্রতিযোগিতা ছিল,লড়াই ছিল। যা পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়েছিল কাটোয়ার পাড়ার ও ক্লাবের পূজায়।

          কাটোয়ার গনিকাদের পূজা মহা ধুমধামেই হত। তাদের টাকার যোগান দিতেন তাদের বাবুরাই সন্দেহ নেই। সেই বাবুরা কি বহিরাগত ! বাংলার নদী তীরবর্তী শহর বা বানিজ্য কেন্দ্রের পূজা পার্বণে সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। কার্তিক পূজায় বিশেষ সমারোহ হয় কাটোয়া,চুঁচুড়া,বাঁশবেড়িয়া,ব্যণ্ডেল,গুপ্তিপাড়া, হুগলি,ডায়মন্ডহারবার ইত্যাদি শহরে। এই সব পূজার বেশ কিছু যে বহিরাগত বনিকদের অবদান সন্দেহ নেই। জলপথ স্থলপথে বণিকরা দূর দুরান্তে গেলেও নিজ আরাধ্য দেবতার কথা ভুলতেন না। পথের বিপদ বা বানিজ্যে সৌভাগ্য কামনায় দেবতাই ছিলেন ভরসা। 

       ভারতে বাংলা ছাড়া কার্তিক বা মুরুগান পূজার বিশেষ ধুমধাম লক্ষ্য করা যায় তামিলনাড়ুতে। বিশেষ এক তামিল সম্প্রদায়ের ইষ্ট দেবতা মুরুগান। ভারতের বাইরে যেখানেই তামিলরা বসবাস করেন সেখানেই এই পূজার প্রচলন এখনও দেখা যায়। যেমন শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর,মালয়েশিয়া,মরিশাস ইত্যাদি। বানিজ্য সুত্রেই তামিলরা গেছেন সেখানে। এই বাংলার কার্তিক পূজাও কি তাদের অবদান!

গঙ্গা তীরবর্তী বানিজ্য কেন্দ্র গুলিতে তাদের পূজা দেখে বা শুনে গনিকারাও শুরু করে পূজা। পরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার গ্রামে গঞ্জে! বাংলার অনেক দেবতাই বহিরাগত। শিবও দক্ষিণের। মাতৃ ভক্ত বাঙালির পিতার অভাব পূরণ করেছেন তিনি। কার্তিক গণেশ হল সন্তান। শিবও প্রথমে ছিলেন বনিকদের পূজ্য দেবতা। বাংলা মঙ্গলকাব্যে দেখি বণিকরাই ছিলেন সমাজের শিরোমনি। তাদের অনুসরণ করত নিচের মানুষ। তাদের স্বীকৃতির মূল্য অসীম। পূজার জন্য দেবী মনসাকে তাই ছুটে আসতে হয়েছিল চাঁদ সওদাগরের কাছে। প্রবল পৌরুষের প্রতীক চাঁদ সহজে মাথা নত করেননি।

“যে হাতে পূজি মুই দেব শূলপাণি
সে হাতে কেমনে পূজি চ্যাঙ মুড়ি কানি।”

     কিন্ত বাংলার জনমত অন্য। তাই বাধ্য হয়েই মান্যতা দিলেন। বাম হাতে পূজা দিলেন মনসার। 

এই বণিকদের হাত ধরেই কি বাংলার মাতৃ সাধনা গ্রহণ করেছে অন্য প্রদেশ। তার পর নতুন নতুন শাস্ত্র পুরাণ, মঙ্গলকাব্যে সেতু বাঁধা হয়েছিল সম্পর্কের। দেবতার ও মানুষের।ভারতে হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্যের বিকাশ হয়েছিল বনিকদের হাত ধরেই। বনিকদের সেই ভূমিকা আজ অন্ধকারে কিন্ত অতীত তার চারনের চিহ্ন রেখে যায় সময়ের বুকে। কাটোয়া তথা বাংলার কার্তিক কি পূজা সেই চারণচিহ্ন!

About News Desk

Check Also

রাজা রামমোহন রায়ের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন

টুডে নিউজ সার্ভিস, কালনাঃ কালনার রামমোহন রায় ছাত্রী নিবাসে মঙ্গলবার উন্মোচন হলো রাজা রামমোহন রায়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *