অভিজিৎ হাজরা, হাওড়াঃ বন্ধ্যাত্ব এক অসুখ। শুধু মহিলারাই নয়, পুরুষেরাও ভোগে বন্ধ্যাত্বে। এই অসুখ থাকলে বিবাহিত দম্পতির সন্তান জন্ম লাভ করে না। তাই বন্ধ্যাত্ব রোগীরা হীনমন্যতায় ভোগে। আধুনিক চিকিৎসায় বন্ধ্যাত্ব নিরাময় সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা ও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম লাভ করে। বন্ধ্যাত্ব দম্পতির মুখে হাসি ফোটে।
দুই বছর বা এর অধিক সময় কোনো ধরণের জম্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া গর্ভধারণে ব্যর্থ হলে তাকে ডাক্তারি ভাষায় বন্ধ্যাত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রতি ১০০ জন দম্পতির মধ্যে ৮৪ টি প্রথম বছরে এবং ৯২ টি দম্পতি দ্বিতীয় বছরের মধ্যে গর্ভধারণ করতে সক্ষম হন। তাই বলা যায় প্রতি ১০০ টি দম্পতির মধ্যে ৮ টি দম্পতি বন্ধ্যাত্বের শিকার হন।
এক বা এর অধিক সময় কোনো ধরণের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া গর্ভধারণে ব্যর্থ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে কারো কারো কনসিভ না হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে দেরী করা যাবে না।যেমন বয়স ৩৬ বা এর বেশি হলে রোগীর পূর্বে এমন কোনো হিস্ট্রি থাকলে যেগুলো তার বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে; যেমন পেলভিক ইনমোকশন এর হিস্ট্রি অথবা এমন কোনো অপারেশন যা তার ফার্টিলিটি কমিয়ে দিতে পারে।
বন্ধ্যাত্বের বহুবিধ কারণ থাকে,স্বামী -স্ত্রী যে কোনো একজন বা উভয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকতে পারে। গর্ভধারণের জন্য দরকার একটি সুস্থ ওভাম (ডিম), সফল বীর্য,নরমাল ইউটেরাস বা জরায়ু এবং নরমাল পেলভিক এ্যানাটমি। এর যে কোনো জায়গায় সমস্যা হলে গর্ভধারণে ব্যর্থতা দেখা দিতে পারে।বন্ধ্যাত্ব শরীরের একটি প্রজননগত অসুখ।যার ফলে শরীরের একটা প্রধান কাজ করা সম্ভব হয় না, সন্তানের জন্ম দেওয়া যায় না।
গর্ভধারণ হল একটি জটিল পদ্ধতি,যা বহু কারণের উপর নির্ভরশীল; পুরুষের সুস্থ শুক্রাণু ও মহিলার সুস্থ ডিম্বাণু উৎপাদন; অবাধ ডিম্বনালী যার সাহায্যে শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাতে পারে; দম্পতির মিলনের সময় শুক্রাণু ডিম্বাণুকে প্রজননক্ষম করার ক্ষমতা; নিষিক্ত ডিম্বাণুটির (ভ্রুণবীজ) গর্ভাশয়ে স্থাপিত হওয়ার ক্ষমতা ও সেটির ভ্রুণে পরিণত হওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা।
বন্ধ্যাত্বের কারণে অনেক সাজানো সংসার ভেঙে গেছে। স্বামী -স্ত্রীর শত সুখ সেখানে খুবই মলিন দেখায়।অজানা থেকে যায় বহুকালের দীর্ঘশ্বাস।এক সময় আমাদের দেশে বন্ধ্যাত্বের জন্য এক চেটিয়া নারীদের দোষারোপ করা হতো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ দু’জনেই সমান দোষী। আসলেই এই বন্ধ্যাত্ব কোনো দোষ নয়, কোনো পাপ নয়। তাই বন্ধ্যাত্বের জন্য নারীদের দোষারোপ করার মন- মানসিকতা পরিহার করতে হবে। সমাজে বা পরিবারে ছোট করে দেখার বিষয় নয়। পরিবারের সকলের ভালোবাসা আর সুচিকিৎসা গ্ৰহণ করলে বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োজন।
নিঃসন্তান দম্পতিদের কথা ভেবে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে, একটি সুখী পরিবার তৈরী করতে উলুবেড়িয়া উত্তর বিধান সভা তথা আমতা-১ ব্লকের একটি বেসরকারি ‘স্নেহা নাসিংহোম’ এর উৎসব ভবন এ অনুষ্ঠিত হল গুরুত্বপূর্ণ ‘বন্ধ্যাত্ব নিরাময় বিষয়ক’ পরামর্শ শিবির।
‘নোভা আই ভি এফ ফার্টিলিটি’ ও ‘স্নেহা নাসিংহোম’ এর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘বন্ধ্যাত্ব নিরাময় ক্লিনিক ‘। এই ক্লিনিকে প্রতি ইংরাজী মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার বন্ধ্যাত্ব দম্পতিদের চিকিৎসা পরিষেবা ওপরামর্শদান শিবির চলছে। এবারের বন্ধ্যাত্ব নিরাময় বিষয়ক পরামর্শ শিবিরটি ছিল চতুর্থ পর্বের । প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিবিরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে এই বৎসরের এপ্রিল-মে-জুন মাসে।
এই আলোচনা শিবিরে স্ত্রী রোগ, বন্ধ্যাত্বের সেকাল-একাল এর প্রসঙ্গ তুলে পুরান, রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী উল্লেখ করে ‘স্নেহা নাসিংহোম’ এর প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুমন সরকার বলেন, সেকালের বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ে নানা কৌশলকে সামনে রেখে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ের আলোর দিশার পাশাপাশি যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে। তিনি এন ওভারভিউ অন গাইনোকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি, এন্ডোমেট্রিওসিস ও পলিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের নানা দিক নিয়ে শিবিরে উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে আলোকপাত করেন। বন্ধ্যাত্ব বিষয়ক আলোকপাত করেন ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট চিকিৎসক রুচি জৈন। পলিস্টিক ওভারিজ নিয়ে আলোকপাত করেন প্র্যাক্টেশিং গাইনোকোলজিস্ট চিকিৎসক অনন্যা ঘোষ গোলুই। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতির সাফল্যের চিত্র ব্যাখ্যা করেন নোভার প্রতিনিধি সম্রাট শীল।
আলোচনা শিবিরে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ আলোচকদের বন্ধ্যাত্ব বিষয়ক নানা প্রশ্ন করেন।আলোচকবৃন্দ তা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন।
আলোচনা শিবিরে শ্রোতাদের এক ঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য আলোচনা পর্ব চলাকালীন মাঝে মাঝে সংগীত পরিবেশিত হয়।
প্রাকৃতিক দূর্যোগকে উপেক্ষা করে ‘বন্ধ্যাত্ব নিরাময় বিষয়ক পরামর্শ শিবিরে প্রায় তিন শতাধিক আশা কর্মী, স্বাস্থ্য কর্মী,গ্ৰামীণ চিকিৎসক, আই সি ডি এস কর্মী, ঔষধ ব্যবসায়ী, কিছু সামাজিক ভাবনার মানুষ পরামর্শ শিবিরে অতিথিদের বক্তব্য মনযোগ সহকারে শোনেন।
এই পরামর্শ দান শিবিরে রাজ্য প্রশাসনিক দপ্তরের আধিকারিকরা যেমন উপস্থিত ছিলেন এর পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক অরুণ পাত্র উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন গ্ৰামের পঞ্চায়েত সদস্য,গ্ৰাম পঞ্চায়েতের প্রধান,উপ প্রধানরাও উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা শিবিরে ‘ স্নেহা নাসিং হোম ‘ এর প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুমন সরকার এর আলোচনায় পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা ও তার সাথে বর্তমান চিকিৎসা শাস্ত্রের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে বলায় উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দ বলেন, চিকিৎসক সুমন সরকার চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্রের বই পড়ার সাথে সাথে যে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত গুরুত্ব সহকারে পড়েন তা প্রমাণ করলেন।