সাংবাদিক সঞ্জিত সেন আত্মঘাতী হয়েছেন। অন্যান্য দিনের মতো শুক্রবারও তিনি অফিসে সব খবর পাঠান। অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। তাঁর সঙ্গে থাকা সাংবাদিকরা কেউ টেরও পাননি, কিছুক্ষণ পর কি ঘটতে চলেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এল সেই দুঃসংবাদ। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কার্বলিক অ্যাসিড পান করেছেন সঞ্জিত। পরিবারের লোকজন তড়িঘড়ি তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। জীবনের শেষদিনও অফিসের দেওয়া দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। কাউকে বুঝতেও দেননি, কী প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে রয়েছেন তিনি। জীবন যুদ্ধে হারলেন সঞ্জিত। কেউ কেউ হয়তো তাঁর আত্মহত্যাকে পলায়ন বৃত্তি বলে মনে করবেন। কিন্তু, কি কারণে সঞ্জিত এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন তার বিশ্লেষণ কি কোনও দিন হবে? আর পাঁচটা আত্মহত্যার মতো সঞ্জিতের ঘটনার পিছনেও পারিবারিক অশান্তিকে সামনে আনা হবে। হতে পারে, পারিবারিক অশান্তি তাঁর আত্মহত্যার একটা কারণ। কিন্তু, সবাইকে অনুরোধ করব কেন এই পারিবারিক অশান্তি তা নিয়ে ভাবুন। সঞ্জিতের আত্মহত্যা সাংবাদিক জীবনের অনিশ্চয়তাকে আরও একবার সকলের সামনে তুলে ধরল। সাংবাদিকদের বঞ্চনাকে তুলে ধরল।
অনেক আশা নিয়ে সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন সঞ্জিত। তাঁর আশা ছিল, এই পেশাকে সামনে রেখেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন সমাজের বুকে। অনেক আশা নিয়ে ক্যামেরা, বুম তুলে নিয়েছিলেন তিনি। বহু ব্রেকিং নিউজ তুলে নিয়ে এসেছেন সঞ্জিত। বহু দূরে গভীর রাতে কোনও ঘটনা ঘটলে অনেক সাংবাদিকেরই ভরসা ছিল সঞ্জিত। কোনও কিছু না ভেবে সাংবাদিক পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ক্যামেরা, বুম নিয়ে একাই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতেন তিনি। বিভিন্ন চ্যানেলে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু, তাঁর স্বপ্ন সফল হয়নি। সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও আর্থিক অবস্থার তেমন কোনও উন্নতি হয়নি তাঁর। বেশকিছু সংস্থায় কাজ করেও তিনি তাঁর প্রাপ্য পাননি। এমন অভিযোগ সঞ্জিত মাঝেমধ্যেই করতেন। সঞ্জিতের এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। জেলায় কাজ করা সাংবাদিকদের এ ধরণের বঞ্চনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। জেলা সাংবাদিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়না। অফিসের সঙ্গে চুক্তিও থাকে না। ন্যূনতম বেতনও জোটেনা। যে কোনও সময় অফিস ছাঁটাই করে দিতে পারে। এছাড়াও অবসরকালীন কোনও সুবিধা থাকে না। পেনশনও জোটে না। এই বঞ্চনা নিয়েই জেলার সাংবাদিকদের কাজ করে যেতে হয়। দেশে শ্রম আইন আছে।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তর আছে, যাদের এ ধরণের বঞ্চনার বিষয়টি দেখার কথা। কিন্তু, সংবাদ অফিসের বঞ্চনা নিয়ে সবাই চোখ বুজে রয়েছেন। শ্রম আইন লঙ্ঘিত হলেও সংশ্লিষ্ট সংবাদ অফিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। রাজনৈতিক দলগুলিও এ ব্যাপারে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। অন্য সব পেশার লোকজনের বঞ্চনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি সরব হয়। তবে, সাংবাদিকদের প্রতি সংবাদ অফিসের বঞ্চনা নিয়ে কি সরকার, কি আদালত, কি রাজনৈতিক দল, সবাই মুখ বন্ধ করে রয়েছে। কারণটা অজানা। হতে পারে সংবাদ অফিসকে কেউই চটাতে চান না। সাংবাদিকদের দুর্নীতি নিয়ে বহু চর্চা হয়। কিন্তু, সাংবাদিকদের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন নিয়ে চর্চা হয় কদাচিৎ। কেন সাংবাদিকরা প্রলোভনে পড়েন তা ভেবে দেখার সময় হয়ত কারুরই নেই। তাই, ‘সঞ্জিত’দের এই করুণ পরিণতি।
Ganendra Nath Bandyopadhyay সাংবাদিক গনেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় @গনাদার ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত
Social