Breaking News

হৃদয়ে একুশ

 

অশোক মজুমদারঃ অতিমারীর চোখরাঙানি না থাকলে আজ একুশে জুলাই কোন পর্যায়ে যেত তা বোধকরি কল্পনার অতীত। জনপ্লাবনের রেকর্ড ভেঙ্গেগড়ে এই দিনটি বাংলা তথা দেশের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারেও হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু একুশের চিরচেনা বৃষ্টিভেজা অবরুদ্ধ কলকাতার রাজপথ এবারও সেই আবেগ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল।

ধর্মতলায় বাঁদিকে ভিক্টোরিয়া হাউস, ডানদিকে ইনকাম ট্যাক্স অফিস। প্রতিবার ২১ জুলাই শহীদ দিবসের ছবি তুলতে চিত্র সাংবাদিকদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া নিয়ে পুলিশ এবং কর্তৃপক্ষের সাথে ঝামেলা হয়েই থাকে। কারণ এই দুটো বিল্ডিং এর উপর থেকেই মানুষের ভিড়ের ছবি ভালোভাবে ওঠে। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা আজকে দেশের অন্যতম বিরোধী নেত্রী ছিলেন সেদিন রাজ্যের বিরোধী মুখ। রক্তস্নাত রাজপথে সেদিনই ভাবীকালের পটভূমি রচিত হয়ে গেছিলো। আজকের মুখ্যমন্ত্রীর জীবনের অন্যতম মাইলফলক ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। সেদিন আমিও আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে তৎকালীন যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযান কভার করতে গিয়েছিলাম। আমার সহকর্মী অনিন্দ্য জানা সহ অনেক সাংবাদিকই পুলিশের লাঠিতে আহত হয়েছিলেন। আমার কিছু হয়নি। কিন্তু নিরস্ত্র মিছিলের ওপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ, বিনা প্ররোচনায় গুলি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরীরে লাঠির আঘাত, সারা ধর্মতলা ডালহৌসি চত্বর যেন যুদ্ধক্ষেত্র –  এইসব দেখে জীবনে সেই প্রথম আমি কেমন যেন একটা হয়ে গেছিলাম।

নিজেকে বাঁচাতে নয়, গুলির আওয়াজ এবং কাতারে কাতারে মানুষের দিকভ্রান্ত ছোটাছুটি, কান্না, দিদির মাথায় হাত দিয়ে ট্রাফিক গার্ডের সামনে বসে পরা এইসব দৃশ্য চোখের সামনে দেখে আমি বোধয় খুব উদ্বিগ্ন হয়ে গেছিলাম। সত্যি বলছি এত বড় ঘটনা আমি পুরোটা লেন্সে ধরে রাখতে পারিনি। বিহ্বল আমি ধরতে পারিনি মুহূর্ত। বোধ কাজ করছিলো না। 

ছবি তুলেছি কিন্তু যেরকম ছবি তুলে ফটোগ্রাফাররা পরেরদিন খবরের কাগজে বাহবা কুড়োলেন, আমি সেখানে কোনো রকমে পাশ করলাম। ভাগ্যিস তারাপদ ব্যানার্জি ছিলেন। তারই ছবি দিয়ে আনন্দবাজার ৯৩-এর সেই ঘটনা ছেপেছিলো।

আজও আমার কাছে রহস্য কেন আমি সেদিন ভালো ছবি তুলতে পারিনি! আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিছনে পিছনে থাকা জনস্রোতে পুলিশের অমানবিক লাঠিচার্জ, তারই ভেতরে দিদির মার খাওয়াটা লেন্সের শাটার না টিপে আমি ক্রমাগত চিৎকার করছিলাম। সৌগত রায়, কৃষ্ণা, সোনালী আরো অনেকেই এটা চাক্ষুষ দেখেছে। আজ যতটা সহজেই বলে ফেলছি সেদিন কিন্তু পরিস্থিতি তা ছিলো না।

সেদিনের পর থেকে প্রতিবছর ২১ জুলাইয়ের শহীদ স্মরণে সারা বাংলার মানুষ এই শহরে জড়ো হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্বালাময়ী রাজনৈতিক ভাষণ শুনতে ও আগামী একবছরের কর্মসূচির পাঠ নিতে। তেরোজনের প্রাণ ও দিদির গুরুতর আঘাতের সাক্ষী ধর্মতলা চত্বর আজকের দিনটিতে আবেগে ভেসে যায়। আমার অভিজ্ঞতায় এইরকম ভিড় প্রায় দেখিনি বললেই চলে।

বড়দের কাছে শুনেছি ইন্দিরা গান্ধী আর মুজিবুর রহমানের মিটিং নাকি রেকর্ডে এখনো পর্যন্ত হায়েস্ট। তারপরে সিপিএম ব্রিগেডে অনেক মিটিংয়ের ভিড় করেছে কিন্তু ২১ জুলাইয়ের সভা সবাইকে ছাপিয়ে গেছে।

কালের বিবর্তনে রাজনৈতিক এই সভায় আমাদের প্রিয় দিদি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, বিপ্লবী, স্কুলের হেডস্যার, কলেজের প্রিন্সিপাল, সাহিত্যিক, সেলিব্রিটি সব ধরনের মানুষকে হাজির করিয়েছেন এবং সম্বর্ধনা দিয়েছেন।

এটা এক অভাবনীয় দৃশ্য যে একটি রাজনৈতিক সভা ধীরে ধীরে কিভাবে সারা বাংলার মানুষের কাছে একটু ভালো থাকার, একটু ভরসার দিন হয়ে গেল। আমার কাছে এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা পরবর্তী ২০২১ এর শহীদ দিবস ভার্চুয়ালি হলেও এবছরের উপরিপাওনা তামিলনাড়ু, দিল্লি, ত্রিপুরা, পাঞ্জাব ,উত্তরপ্রদেশ সহ বহু রাজ্যেই এই সভা দেখা যাবে। কারণ লক্ষ্য ২০২৪ এর লোকসভা ভোট। রাজনৈতিকভাবে কি হবে, কি হবেনা তা এখন থেকে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার সাথে বাংলার বহু মানুষ আশা করি একমত হবেন যে এই দানবীয়, মিথ্যুক বিজেপি সরকারকে উৎখাত করতে না পারলে ভারতবর্ষ কিন্তু মহাসংকটে পড়বে।

আর এই ২০২১ এর নির্বাচনে মোদীবাহিনীকে যেভাবে দিদি উৎখাত করলেন অন্যান্য রাজ্যের মোদী বিরোধী নেতারা আশাকরি দিদির ক্ষমতা সম্পর্কে এবার ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছেন।

শুধু তাই ভাঙ্গা পায়ে গোল নয় গোলের রেকর্ড করেই উনি ক্ষমতায় এলেন এবং সেটা মানুষের আশীর্বাদেই। দিদি বারবারই বলেন, ‘তিনি দায়বদ্ধ একমাত্র মানুষের কাছে।’ সেদিনও তিনি মানুষের কথা বলতেন। আজও তাই। যে কারনে শহীদ স্মরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ থাকবে কিন্তু একুশের গণউন্মাদনা এবারো দেখতে পাওয়া যাবেনা।

About Burdwan Today

Check Also

কার্তিক লড়াইকে ঘিরে জমজমাট কাটোয়া

রাহুল রায়, কাটোয়াঃ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের সকলের কাছে সব থেকে বড় পুজো হল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *