শুভদীপ দত্ত, মহেশতলাঃ সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানুষ নিজের প্রখর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত থেকে উন্নততর সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়েছে। কালের নিয়মে জন্ম নিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি; জীবন লাভ করেছে এক অনন্য মাত্রা। সভ্যতার জয়যাত্রার পথে মানুষ আজ ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ অব্দি পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু, পাশাপাশি একথাও সত্য যে পৃথিবীর বুকে সভ্যতা যতই জাঁকিয়ে বসেছে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের জীবনের নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। ভিন্ন ভিন্ন যুগে জীবনের এই প্রতিকূলতার রুপও ভিন্ন ভিন্ন। একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার শিখরে বাস করেও মানুষ ভয়ঙ্কর এক মহামারির মোকাবিলা করতে পারেনি যা হল আমাদের সকলের জানা করোনা মহামারির। উন্নত, অনুন্নত বা উন্নয়নয়নশীল কোন দেশই করোনা নামক মহামারির কবল থেকে রেহাই পায়নি। করোনা এমনই এক রোগ যা অতি দ্রুত মানুষকে আক্রান্ত করে সংক্রমনের মাধ্যমে। এটা নতুন রোগ সেজন্য এর প্রতিষেধক এখন সার্থকভাবে আবিষ্কার হয়নি। ফলে এই রোগে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। এই রোগকে এখন শুধু মহামারি বললে সঠিক বলা হবে না, এই রোগটা অতিমারিও বটে।
মহামারী কি?
মানব সভ্যতার মতো পৃথিবীতে মহামারীরও এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। করোনা ভাইরাস কে জানতে বা বুঝতে গেলে সর্বপ্রথম মহামারী সম্বন্ধে অবগত হওয়া প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, আসলে কি এই মহামারী? কোন একটি রোগের জীবাণু যখন কোন কারনে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে বলে স্থানীয় সংক্রামক ব্যাধি। সেই জীবাণুই যখন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের গন্ডি পেরিয়ে একটি বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে বিস্তার লাভ করে এবং সংক্রমনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তখন তা একটি মহামারী বা ই-প্যানডেমিক আখ্যায়িত হয়। আবার, সেই রোগই যখন দেশ বা মহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তখন তা বিশ্বমহামারী, অতিমারী কিংবা প্যানডেমিক নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতিটি মহামারীর সংক্রমণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ চরিত্র বা ধরন থাকে। কোন ক্ষেত্রে মহামারী ছড়ায় প্রতিদিনের ব্যবহৃত জল থেকে, কোন ক্ষেত্রে কোন রোগবহনকারী জীব থেকে, কখনো বা কোন ধরনের ছত্রাক থেকে; আবার কখনো মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি।
করোনার লক্ষণ ও সংক্রমণ : করোনা রোগীর সাধারণত যেসকল লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হল – কাশি, গলা ব্যথা, জ্বর, হাঁচি, শ্বাসকষ্ট। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে অল্প চিকিৎসায় মানুষ সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু, বয়স্ক ব্যক্তিরা যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত অর্থাৎ কোমরবিডিটি আছে তাদের জন্য এই রোগ বিপদজনক। করোনা একটি সংক্রামক ব্যাধি বা নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়। ২০২১ সালে এসে যেসকল নতুন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তা হল – চোখ উঠা, বুক ব্যাথা, গলা ব্যাথা, ডায়রিয়া, হাত ও পায়ের আঙুলের নোখ ফ্যাকাসে হওয়া, মাথা ব্যাথা সহ চামড়ায় ফুসকুড়ির মত প্রভৃতি লক্ষণীয়।
কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা ভাইরাসে (এনকোভিড -১৯)-র উৎস সম্পর্কে পৃথিবীজুড়ে আজও সমূহ বিতর্ক বিদ্যমান। কারোর মতে এই ভাইরাস কৃত্রিম উপায়ে গবেষণাগারে তৈরি আবার, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন এই ভাইরাসের উৎস হলো বাদুড়। তবে কোন মহলই এই ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। যে একটি ব্যাপারে মোটামুটি সকলেই নিশ্চিত তা হল এই ভাইরাসের গ্রাউন্ড জিরো অর্থাৎ, এই সংক্রমণ সর্বপ্রথম কোথা থেকে শুরু হয়েছিল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীন দেশের হুনান প্রদেশের রাজধানী উহান শহরের একটি মাংসের বাজার থেকে। সেখান থেকেই এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে এক বিশ্ব মহামারী আকার ধারণ করে। রোগটা শনাক্ত করার আগেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বহু মানুষ থেকে সমাজ থেকে দেশে-দেশান্তরকে আক্রমণ করে। ২০২০ সালের ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা রোগটিকে মহামারী বলে ঘোষণা করে। সারাবিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়লেও চীন, আমেরিকা, ইতালি, ব্রিটেন, ব্রাজিল, ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশে এই রোগ দ্রুত ভয়াবহ রূপ নেয়। এই দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুর হারও বেশি বর্তমানে। তবে এই ভাইরাসটির সংক্রমন বিশেষজ্ঞদের মতে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত।
প্রথমটি হল, এমন ধরনের মানুষ যারা বিশেষভাবে সংক্রমিত অঞ্চল থেকে সরাসরি সংক্রমিত হয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়টি হল, যেখানে সরাসরিভাবে সংক্রমিত হওয়া সেই সব মানুষ গুলি নিজেদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য মানুষদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়।
তৃতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এক বৃহত্তর অঞ্চল জুড়ে। এই পর্যায়ে সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না আসা ব্যক্তিও তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সংক্রমিত হয়। এটি গোষ্ঠী সংক্রমনের পর্যায় হিসেবে পরিচিত।
চতুর্থ বা অন্তিম পর্যায়ে সংক্রমণ রাজ্য কিংবা দেশজুড়ে এক মহামারীর আকার ধারণ করে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এই চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে ভ্যাকসিন ছাড়া তাকে রোধ করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে।
রোগ মুক্তির উপায় : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবকে। প্রায় এক বছর পরেও করোনার প্রতিষেধক এখনো সঠিকভাবে আবিষ্কৃত না হওয়ায় এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে এবং এক শহর থেকে অন্য শহরে। এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কতগুলি সাবধানতা অবলম্বন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য সেগুলি হল – বারবার হাত ধোওয়া অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, নিজের নাকে, মুখে অপরিষ্কার হাত না দেওয়া, বাইরে বের হওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। শারিরীক দূরত্ব মেনে চলা, বহু মানুষ একত্রে জমায়েত না হওয়া এবং সঠিক খাদ্য গ্রহণ করা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মত জীবন যাপন করলে এই রোগের হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যায়।
পরিসংখ্যান : বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারিতে আক্রান্ত ১৩৯,৫০১,৯৩৪ জন, যার মধ্যে করোনাতে মারা গেছেন ২,৯৯২,১৯৩ জন এবং ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৭৫১,৪৫২,৫৬৩ জন। আক্রান্তের নিরীখে দেশগুলো হল যথাক্রমে – আমেরিকা (৩১,১৭৬,৯৩৮), ভারত (১৪,৫২৬,৬০৯), ব্রাজিল (১৩,৭৪৬,৬৮১), ফ্রান্স (৫,১৪৪,২৯৫) এরপর রয়েছে অন্যান্য দেশগুলি।
কথায় বলে, সভ্যতা যখন নিজের গতিকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করে, সৃষ্টি তখন সমগ্র সভ্যতাকে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। একটি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক ভাইরাস যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই প্রবাদবাক্যের সত্যতাই প্রমাণ করে দিল। আবারো আমরা দেখতে পেলাম সৃষ্টির কাছে আমরা ঠিক কতখানি অসহায়। অন্ধকার রাত্রির পর আসে একটা সুন্দর ঝকঝকে সকাল, তেমনি বিশ্বের ‘গভীর গভীরতর অসুখ’-র গ্লানি মুছে যাবে পৃথিবী আবার সুন্দর ও শান্ত হবে। এই আশা নিয়ে মানুষ বাঁচে। ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি’, মহামারির কবলে আগেও মানুষ পড়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ আশা করে যে, এই অকাল দিনের হাত থেকেও আমরা উদ্ধার পাবো। আশার কথা সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীরা অনলস ভাবে চেষ্টা করে চলেছেন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। পূর্বে এঁদের চেষ্টা বৃথা যায়নি যার ব্যতিক্রম বর্তমানেও হবে না। অনেক দেশই দাবি করছেন যে তারা প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছেন, আমাদের দেশ ভারতবর্ষও পিছিয়ে নেই, করোনা-টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
Social