দেবনাথ মোদক, বাঁকুড়াঃ পুজো আসতে আর হাতে গোনা কয়েকদিন মাত্র সময়। সেই পুজোর ছুটিতে অনেকেই কলকাতার আশেপাশের কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পছন্দ করে। এবারে সেই ছুটি কাটাতে পারেন ইতিহাসের গন্ধ লেগে থাকা বিষ্ণুপুর শহরের বুকে। কেননা এই শহরে বা তার আশেপাশে দেখার জিনিসের অভাব নেই।
বিষ্ণুপুর ছিল মল্ল রাজাদের রাজধানী। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই শহরের পত্তন ঘটে রাজা জয় মল্লের হাতে ধরে। তার আগে মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল কোতুলপুরের কাছে লাউগ্রামে। মল্ল রাজারা ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। সেই থেকেই বিষ্ণুপুর নামের উৎপত্তি। তারও পরে ১৫৯১ থেকে ১৬১৬ বীর হাম্বীরের রাজত্ব কালে চৈতন্য-শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর রাজ্য জুড়ে শুরু হয় মন্দির নির্মাণ। শুধুমাত্র বিষ্ণুপুরেই দর্শন্য মন্দিরের সংখ্যা ২৫টির বেশি। যা থেকে মন্দির নগরীর তকমা জুটে যায় প্রাচীন এই শহরের মাথায়। বিষ্ণুপুর হয়ে ওঠে দক্ষিণবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন-শহর। ঐতিহাসিক প্রাচীন মন্দিরগুলি ছাড়াও এ শহরের সম্পদ বালুচরী, শঙ্খ, কাঁসা-পিতল, লণ্ঠন, দশাবতার তাসের মতো নিপুন হস্তশিল্পগুলি।
প্রাচীনত্বের শিকড় বহু দূর অবধি ছড়িয়ে থাকলেও বিষ্ণুপুর শহরের মন্দিরনগরীর নির্মাণস্থাপত্যগুলি তাদের স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছিল সপ্তদশ শতকে, মল্লরাজ বীর হাম্বিরের শাসনে। তাঁর তৈরি যে নির্মাণগুলি এখনও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘রাসমঞ্চ’। পিরামিডেরন ধাঁচে এই ধরনের রাসমঞ্চ বাংলার বুকে তো বটেই, গোটা দেশে বা এশিয়া মহাদেশেও দ্বিতীয়টি নেই। রাসমঞ্চের কাছেই ‘জোড়বাংলা’ মন্দির। ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা রঘুনাথ সিংহ দেব দ্বিতীয় এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন গ্রামবাংলার দু’টি আটচালার ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে টেরাকোটার কাজ মনে করিয়ে দেয় বাংলার চালচিত্রকে। রাজা রঘুনাথের তৈরি ‘পঞ্চরত্ন মন্দিরও’ ইতিহাসের আর এক অপরূপ নিদর্শন। বিষ্ণুপুরের সব মন্দিরই বিখ্যাত টেরাকোটার কারুকাজের জন্য। ব্যতিক্রম নয় মদনমোহনের মন্দিরও। ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এই দেবালয়ের গায়ে খোদাই করা আছে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের নানা কাহিনি। শহরের অসংখ্য মন্দিরের মধ্যে দর্শনীয় বাকি মন্দিরগুলি হল লালজি মন্দির, রাধাশ্যাম মন্দির, নন্দলাল মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির এবং জোড় মন্দির। প্রায় কোনও মন্দিরেই এখন আর পুজো হয় না।
মন্দিরের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের অন্যতম আকর্ষণ দলমাদল কামান। কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে, রাজা বীর হাম্বিরের সময়ে তৈরি করানো হয়েছিল এই কামান। আবার কোনও কোনও গবেষকের মত, ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজা গোপাল সিংহের সমসাময়িক এই কামান। জগন্নাথ কর্মকারের তৈরি এই কামানের গোলায় ভর করে মরাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন মল্লযোদ্ধারা। খোলা আকাশের নীচে কয়েকশো বছর ধরে থেকেও এতে কোনও মরচে ধরেনি। ভক্তিরসের সঙ্গে বীররসের প্রতীক মল্লযোদ্ধাদের এই কামান। কথিত আছে, বর্গি সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে দলমাদল কামান দেগে হটিয়ে দিয়েছিলেন রাজবাড়ির গৃহদেবতা মদনমোহন। ১৫৮৬ থেকে ১৬২১- মুঘল-আফগান লড়াইয়ে মুঘল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মল্লরাজ বীর হাম্বীর। তখন থেকেই মুঘলদের সাহায্যে কামান তৈরির পল্লি গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুরে। নাম দেওয়া হয় কামনটোলা। কর্মকার শ্রেণির মানুষেরা আসতে থাকেন। আসেন রাজনর্তকী লালবাঈ। তানসেনের দৌহিত্র বাহাদুর খাঁ।
বিষ্ণুপুর থেকে ২২ কিমি দূরের পাঁচমুড়া বিখ্যাত টেরাকোটা শিল্পের জন্য। তবে অতদূর না গিয়েও বিষ্ণুপুরে আপনি পেয়ে যাবেন পছন্দসই পোড়ামাটির হস্তশিল্প। কিনতে পারেন বালুচুরী ও স্বর্ণচুরী শাড়িও। হাতে সময় থাকলে আপনি ঘুরে আসতে পারেন শুশুনিয়া পাহাড়, মুকুটমণিপুর এবং জয়রামবাটিতেও। সেই সঙ্গে অবশ্যই দেখে নেবেন বিষ্ণুপুরের মধ্যে থাকা রাজআমলে তৈরি লালবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, শ্যামবাঁধের মতো বিশাল জলাশয়গুলি। দেখতে ভুলবেন না মিউজিয়াম ও রাজবাড়ি লাগোয়া মৃন্ময়ী মন্দির, গুমঘর, পাথরের রথ, দুর্গের প্রবেশদ্বার। কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব ১৩৮ কিমি। সড়কপথে যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টার কিছু বেশি। যেতে পারেন রেলপথেও। বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাসের জন্য অনেক লজ এবং হোটেল আছে। মন্দিরনগরী দেখার পরে অনেকেই রাত্রিবাস না করে সেদিনই ফিরে আসেন।
Social