ইমরান হোসেনঃ কবি জীবনানন্দ দাশের “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে” এখন যেন অতীত। আজকের সময়টা হল, ঘণ্টার পর ঘণ্টার স্ক্রলিং করে চলেছি ফেসবুকের পথে। প্রতি স্ক্রলিং-এ কিছু সেকেন্ড থেমে যাওয়া, তারপর আবার এগিয়ে যাওয়া ‘রিলস’- এর নেশায়। এক অদ্ভুত আকর্ষণে ‘রিলস বন্দি’ সবাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুড়ো আঙুলের নড়াচড়া চলে। আর সেখানেই মোহচ্ছন হয়ে থাকে ৮ থেকে ৮০ বছর বয়সি সকলেই। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং ইউটিউব রিলসের নেশায় বুঁদ শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের এক মুহূর্ত স্মার্টফোন ছাড়া চলে না। মনের অজান্তেই বারেবারে স্মার্টফোনে ঢুঁ মারে সবাই। স্মার্টফোনের লকটা খুলে বার বার নোটিফিকেশন দেখা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফাইভ জি-র এই ব্যস্ততম যুগে আমাদের বাস্তব জীবনের চেয়ে অনলাইন জীবনই বেশি প্রাধান্য পায়। একটু খবর দেখা, অনলাইনে কেনাকাটা করা, বন্ধুদের ছবি বা ভিডিও দেখা- এমন বিভিন্ন কারণে আমরা কয়েক মিনিট পরপর ফোন দেখতে থাকি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যান্য সকল ফিচারকে ছাপিয়ে এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে রিলস। সময়ের আবহমান স্রোতে দীর্ঘ সময়ের ভিডিও থেকে উদ্ভব হওয়া সেকেন্ড-সূচক ভিডিও হল রিলস। ট্রেনে যাত্রা করার সময় বা প্রতিক্ষালয়ে আমাদের পাশে বসা মানুষটার থেকে আমরা বেশিবার তাকায় স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। এই রিলস দেখার ব্যস্ততায় চেনা মানুষগুলোও অনেক সময় অচেনা হয়ে উঠে। আমাদেরকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার থেকে বেশি আকর্ষিত করে এই স্মার্টফোন এবং রিলস। ছোট্ট দুধের শিশুকে ব্যস্ত রাখতে, কান্না থামাতে রিলস ভিডিও চালু করে দেয় মা-বাবা। শিশু উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে রিলসে আসক্ত হয়ে উঠে।
রিলস ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে বলা যায়। ভাইন (এখন মৃত), স্ন্যাপচ্যাট, টিকটোক এবং ইনস্টাগ্রাম রিলসের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো প্রবর্তনের সাথে, সোশ্যাল মিডিয়ার ল্যান্ডস্কেপে একটি অসাধারণ রূপান্তর ঘটেছ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইন (Vine) ২০১৩ সালে চালু হয়।, ছয় সেকেন্ডের এই লুপিং ভিডিওর ধারনা থেকেই রিলস এর জন্ম। রিলসের ইতিবাচক দিকগুলোও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অত্যন্ত কম সময়ে কোন মেসেজ বা ঘটনার মোটা মোটা তথ্যগুলো তুলে ধরে এই রিলস, যা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু সমস্ত নবাগত প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয় দিক বর্তমান, ঠিক তেমনই রিলসের প্রভাব ইতিবাচকের সঙ্গে নেতিবাচকও বটে। রিলসে আসক্তি আমাদের মস্তিস্কে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে।
বিশ্ব বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ মিরটিস ফস বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক সর্বদায় কাজে ব্যস্ত থাকে। এমনকি আমাদের ঘুমানোর সময়ও সে জেগে থাকে। মস্তিষ্কে থাকা ডোপামিন আমাদেরকে ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করে এবং আমরা আনন্দ পায়। মিষ্টি খাবার খাওয়া, ভালো মুভি দেখা, জোকস শোনার জন্য ডোপামিন আমাদের পুরস্কার দেয়। এই সমস্ত কর্মের বদৌলতে আমরা আনন্দ পায়। স্মার্টফোনে যে ছবি বা রিলস ভিডিও দেখি তারও এই রকম প্রভাব আছে। কিন্তু অনলাইন দুনিয়ার পরিবর্তনশীল রিলস-এ অনবরত আনন্দ-দুঃখ মিশে যেতে থাকে। আনন্দের রিলস স্ক্রোল করতে করতে হঠাৎ একটি দুঃখের রিলস সামনে চলে আসে। এমনটা প্রায়ই হতে থাকে। ফলত মস্তিস্কে আনন্দ এবং দুঃখের প্রতিক্রিয়া উলটপালট হতে থাকে। ফলত মস্তিস্কের পুরস্কৃত করার কার্যকারিতা ক্রমেই কমতে থাকে, যে কারণে আমাদের আরও বেশি রিলস দেখার ইচ্ছা মনে জাগে। তখনই আমরা রিলস দেখতে আসক্ত হয়ে পড়ি।
রিলস ভিডিও তৈরি করে ভাইরাল হওয়া অনেক ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী নেশায় পরিণত হয়। রিলস ভিডিও বানাতে গিয়ে জীবনও যাচ্ছে অহরহ। জলের স্রোতের রিলস বানাতে গিয়ে মৃত্যু হয় বারুইপুরের মহম্মদ শামিম নামক এক কিশোরে। বারুইপুরের উত্তর ভাগ পাম্পিং স্টেশনে বর্ষার জল পড়ার সময় নয়নাভিরাম স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই দৃশ্যের রিলস বানানোর সময় অতর্কিতে জলে পড়ে যায় সে। বাকি বন্ধুরা তাকে আটকানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। প্রবল স্রোতে ভেসে যায় সে। মুর্শিদাবাদের সুতিতে আহিরন ব্রিজের উপর বন্ধুরা মিলে রিলস বানাতে গিয়ে মালগাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় তিনজন কিশোরের। কর্ণাটকের শিবমোগ্গারই আরাশিনাগুন্ডির বিখ্যাত জলপ্রপাত দেখতে এসেছিল দুই বন্ধু। ইনস্টাগ্রামের রিলস বানানোর জন্য তীব্র গতিতে বয়ে যাওয়া ঝরনার সামনে একটি পাথরের উপরে দাঁড়ায় এক বন্ধু। পিছনে দাড়িয়ে রিলস ভিডিও রেকর্ডিং চলছিল দ্বিতীয়জনের মুঠোফোনে। আচমকায় ছন্দরপতন ঘটে। পা পিছলে গিয়ে জলের তোড়ে তলিয়ে যায় প্রথমজন। এক বন্ধুর ক্যামেরায় বন্দি হয় অন্য বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার রিলস ভিডিও। সামাজিক মাধ্যমে ফলোয়ার বৃদ্ধির নেশায় পড়ে মানুষ মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ছে। সরকারিভাবে বহু পর্যটন কেন্দ্রে সতর্কতামূলক রিলস তৈরি নিষিদ্ধ করাও হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রিলস তৈরি করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী মানুষজনকে চরম অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেয় কন্টেন্ট প্রস্তুতকারকরা।
অনলাইন কন্টেন্টের জগতে রিলস ভিডিও নিঃসন্দেহে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ফাইভ জি-এর যুগে দীর্ঘ সময় ভিডিও দেখার সময় এবং ধৈর্য দুই হারিয়েছে। অপরদিকে কয়েক মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে নেয় একটি জনপ্রিয় রিলস। রিলস-এর জগৎ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে ঘণ্টার পর ঘণ্টার আটকে রাখে স্মার্টফোনে। রিলস তৈরি, ভাইরাল করা এবং রিলস দেখার সহজলভ্যতা এই জনপ্রিয়তার মুখ্য কারণ বলা যায়। তাই রিলসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পর্যালোচনার মানসিকতা এবং নিয়ন্ত্রণ দুই থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। রিলস দেখার ক্ষেত্রে সময়ের দাবি হল, প্রজুক্তির এই চরম উন্নতির যুগে কোনক্রমেই যেন স্মার্টফোন আমাদেরকে বশ করতে না পারে। আমাদের বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণে থাকুক বুড়ো আঙুল, আর বুড়ো আঙুলের নিয়ন্ত্রণে থাকুক রিলসের স্ক্রলিং।
সৌজন্যেঃ দৈনিক পূবের কলম
Social