সুমন ভট্টাচার্যঃ ‘ক্যাটল ক্লাস’ অর্থাৎ গবাদি পশুর মতো জীবন। সোমবার, ইদের দিন সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার পরে আবার এই উদাহরণটাই মনে পড়ে গেল। আমজনতা, বা সাধারণ নাগরিকদের কতটা গুরুত্ব আছে ভারতবর্ষের বর্তমান সরকারের কাছে? ‘বন্দে ভারত’-এর নামে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজ্ঞাপন দিতে ব্যস্ত ভারতের রেলমন্ত্রক কি আদৌ ভাবে সাধারণ ট্রেনগুলোর কথা? সেই ট্রেনের যাত্রীদের কথা? এমনতর প্রশ্ন মাথায় আসার কারণ যে, ২০২৩-এর জুন মাসে বালাশোরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরে, এক বছরের ব্যবধানে সেই একই জুন মাসে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসেরও দুর্ঘটনা ঘটল এবং এক বছরের ব্যবধানে একই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেন ট্রেনে ‘কবচ’ মানে সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না কিংবা কেন রেললাইনের সিগন্যালিং পদ্ধতিতে এত বড় ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল যে, একই লাইনে দুটি ট্রেন পরপর চলে আসতে পারল!
যদি কেউ মনে রাখেন, তাহলে নিশ্চয়ই স্মরণে আসবে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা, সরকারি হিসেবে যে ঘটনার ২৯৬ জন মারা গিয়েছিলেন, তারপরও একইধরনের প্রশ্ন উঠেছিল। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় বালাশোরে করমণ্ডলের ট্রেন দুর্ঘটনার পরে গেরুয়া শিবিরে ট্রোল বাহিনী যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তার কাছাকাছি মসজিদ ছিল এবং সেখান থেকেই কোনও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ চক্রান্ত হয়েছিল, এমনতর ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরের এক বছরে ট্রোল বাহিনীর এই ন্যারেটিভের সমর্থনে কোনও তথ্য প্রমাণ নরেন্দ্র মোদি সরকারের রেলদফতর বা কোনও তদন্ত কমিটিই দিতে পারেনি। এবারেও কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পরে সেই একই ট্রোল বাহিনী রটানোর চেষ্টা করেছিল যে, মালগাড়ির চালক, তিনি যেহেতু ‘সংখ্যালঘু’, ‘তাই না কি’ ইচ্ছে করে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পরে দেখা যায় মালগাড়ির চালক এবং সহ-চালক দুজনেই হিন্দু। তাতে ট্রোল বাহিনীর উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়লেও রেল মালবাহী ট্রেনের চালককেই ‘দোষী’ প্রমাণিত করে নিজেদের যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলতে তৎপর। আর যেহেতু ওই অভিশপ্ত মালবাহী ট্রেনটির চালক অনিল কুমার দুর্ঘটনায় নিজেই মারা গিয়েছেন, তাই তাঁর এ বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ নেই।
কেন ‘কবচ’ নেই, কেন শিলিগুড়ি-কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ রেলপথে তিনঘণ্টারও বেশি সিগন্যালিং ব্যবস্থা অকেজো ছিল, কেন রেলমন্ত্রী দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছে রিল বানাতে বেশি ব্যস্ত থাকেন, এইসব জরুরি প্রশ্নকে এড়াতে রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য ইতিমধ্যেই নিহত মালবাহীর চালক অনিল কুমারের বিরুদ্ধে এফ আই আর করে মামলা রুজু করে দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, শিলিগুড়ির বাসিন্দা এবং ওই ট্রেনের যাত্রী চৈতালি মজুমদার বলে যে মহিলার জবানবন্দির ভিত্তিতে মালবাহী ট্রেনের মৃত চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, সেই চৈতালি দেবী টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁর ওই মালবাহী ট্রেনের চালকের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্যই নেই। তাহলে কেন এই অতি তৎপরতা? কেন একের পর এক রেল দুর্ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা? আসলে তা নাহলেই তো প্রশ্ন উঠবে, ভারতীয় রেল কি শুধুমাত্র ‘বন্দে ভারত’ চালাতে চায় আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজ্ঞাপনের ঢাক পেটাতে চায়? অর্থাৎ, রেল কি শুধুই বড়লোকদের চলার জন্য? সেইজন্যেই ‘বন্দে ভারত’ নিয়ে প্রচারের ঢাক পেটানো হবে আর ‘বুলেট ট্রেনের গাজর’ আমাদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হবে? সমাজের বা রাষ্ট্রের ‘ক্রিমি লেয়ার’, যারা হয়তো মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের বেশি নয়, সেই ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের অতিক্রম করে আমজনতার কথা কবে নরেন্দ্র মোদির সরকার ভাববে?
রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদির সরকার আসলে ‘স্যুট-বুট’-এর সরকার। অর্থাৎ, তিনি বারবারই নরেন্দ্র মোদির সরকারকে নিশানা করেছেন গরিবদের স্বার্থকে উপেক্ষা করার জন্য। বিরোধীদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদির সরকার আসলে ভারতীয় রেলকেও আদানিদের হাতে তুলে দিতে চায়। ঠিক যেমনভাবে দেশের অধিকাংশ সমুদ্র বন্দর এবং বিমানবন্দরও মোদি ঘনিষ্ঠ এই শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রায়বেরেলির সাংসদ বারবারই অভিযোগ করেছেন, আসলে মোদি-শাহের যুগলবন্দি শুধুমাত্র ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট’দেরই সাহায্য করে। তাই রেলের তিন লাখ শূন্য পদে কোনও নিয়োগ হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই ছিল, ‘ইন্ডিয়া’ জোট সরকার গড়তে পারলে কেন্দ্রের ৩২ লক্ষ শূন্য সরকারি পদে অবিলম্বে নিয়োগ করা হবে। তার মধ্যে অবশ্যই রেলের শূন্যপদে নিয়োগের বিষয়টিও ছিল।
‘ইন্ডিয়া’ জোট সরকার গড়তে পারেনি, কিন্তু তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসা মোদি সরকারের ভারতবর্ষের রেল নিয়ে ভাবনাটা ঠিক কী? এই প্রশ্ন ওঠার কারণ গত চার বছরে ভারতীয় রেলের ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মোদি সরকারের রেলমন্ত্রী, টেকনো ক্র্যাট অশ্বিনী বৈষ্ণব নয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়ার জন্য ‘রিল’ বানান, আর না হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কত মহান সেই তথ্য প্রচারে ব্যস্ত থাকেন! তাই দেশে ২০০টি মডেল স্টেশন তৈরি হচ্ছে, প্রচারের এই ঢক্কানিনাদ আমরা শুনতে পেলেও জানতে পারি না রেল ট্র্যাকের আধুনিকীকরণ বা রেল সুরক্ষার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আসলে গোটা মোদি সরকারটা এইরকম ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বা হেডলাইন ম্যানেজমেন্টের নীতি নিয়ে চলছে। সেখানে প্রচারের ঢক্কানিনাদ আছে, ‘গোদি মিডিয়া’ তো বটেই, মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতেও নির্লজ্জভাবে শাসকের পদলেহন আছে, কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা যেসব প্রশ্ন নিয়ে জর্জরিত, তার কোনও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা নেই। এটাই কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে প্রতিটি দফতরের কাজের, বা ‘অকাজ’-এর ধরন। রেলও তার ব্যতিক্রম নয়।
মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন অ্যাঙ্কর রাজদীপ সরদেশাই ট্যুইটে লিখেছেন, বিজেপি চায় না টেলিভিশনে রেল দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা হোক। বরং তারা অনেক স্বচ্ছন্দ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কেরালা থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা নিয়ে। এবং আশ্চর্যের বিষয় মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বিজেপির অঙ্গুলিহেলনে সেই কাজটাই করে চলেছে। তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে, বিজেপি তো বটেই মেইন স্ট্রিম মিডিয়াও ভুলে গিয়েছে যে, ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোন আয়সীমার মধ্যে রয়েছেন বা তাঁদের চিন্তাভাবনায় আসলে কোনটা গুরুত্ব পায়? এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির একদল লোক সমাজমাধ্যমে প্রচার করে যে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে লোকের চাকরি হবে! যে সরকার কেন্দ্রে ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে রেল তো বটেই, সব সরকারি দফতরেই নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের কাছ থেকে কর্মসংস্থানের বিষয়ে কতটুকুই বা আশা করা যায়?
দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি অতীতে কেন্দ্রে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন, তিনি মোদি সরকারকে নিশানা করেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা লালু প্রসাদ যাদব যখন কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন এমন অনেক কিছু করেছেন যা গরিব মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করত। সেই সময় এইসব কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা লালু প্রসাদ যাদবকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি। বিজেপি, বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে নরেন্দ্র মোদি ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় বসলেও নিজেকে বারবার বড়লোকদের ‘বন্ধু’ বলেই প্রমাণ করছেন আর তাঁর সরকারের কাজকর্ম বলে দিচ্ছে গরিবদের প্রাণের কোনও মূল্য নেই এই ভারতবর্ষে। নরেন্দ্র মোদির ‘অমৃতকাল’-এ গরিব প্রান্তিক মানুষরা ‘লাশ’ হয়ে গেলেও তাঁর রেলমন্ত্রী ‘রিলমন্ত্রী’ হয়েই থেকে যাবেন।
Social