Breaking News

তালের গল্প

উজ্জ্বল সাউঃ গ্রামের মানুষের কাছে তাল একটি জনপ্রিয় ফল। তাল এক সময় ভরা ভাদ্রে গ্রামের মানুষের পেটের খিদে মিটিয়েছে। যখন নদী বাঁধ পরিকল্পনা রূপায়িত হয়নি তখন বাংলার বহু গ্রাম বর্ষাকালে এবং ভরা ভাদরে ফি-বছর বন্যার কবলে পড়ত,মাঠের রোপিত ধানের চারা অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যেত।খাদ্যের জন্য তুলে রাখা যৎসামান্য ধান অথবা লক্ষ্মী হাঁড়ির ধান,নতুন করে চাষের জন্য বীজ ধান রূপে ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন অধিকাংশ গ্রামের মানুষ।সেই সময় গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও মজবুত ছিল না—ফলত ফি-ভাদ্রে গ্রাম বাংলার অধিকাংশ ঘরে ভাতের চাল ফুরিয়ে যেত—ভাদ্রে চরম খাদ্য সংকটে পড়তে হতো গাঁয়ের প্রান্তিক এবং সাধারণ মানুষকে। ভাদ্র মাস এক সময় গ্রামের মানুষের কাছে ছিল—”দুঃসময়”!বাংলা প্রবাদেই আছে—”কারো পৌষ মাস,তো কারো ভাদ্র মাস”।বেশ কয়েক দশক আগে—সেই দুঃসময়ে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে গ্রামের ঘরে ঘরে চালের জন্য ভাতের হাঁড়ি চড়ত না,তখন ভাদরে পাকা তাল গ্রামের প্রান্তিক-গরীব মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করেছে।পাকা তালের মাড়ি-নির্যাস মুড়ির সাথে মাখিয়ে খেয়ে অনেক গরীবের ভাদর কেটেছে!তালের এই কাহিনী হয়তো অনেকেই পুরানো মানুষদের কাছে শুনে থাকবেন অথবা অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মনের মনিকোঠায় স্মৃতি হয়ে আছে!

এখন গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে,সেই খাদ্য সংকটও আগের মতো নেই।তবে গ্রামের মাঠেঘাটে,পথের ধারে,ফাঁকা প্রান্তরে,পুকুর পাড়ে—তাল গাছের সংখ্যা অনেকখানি কমে গেছে।উন্নয়নের দোহায় তাল গাছ মূল্যহীন হয়ে পায়ের নীচের মাটি হারিয়েছে,নির্বিচারে কাটা পড়েছে দিনে দিনে।অনেক গ্রামে পুকুরের নাম আছে—”তালপুকুর”।হয়তো এক সময় পুকুর পাড়ে ছিল তালসারি।বর্তমানে পুকুরের নাম— “তালপুকুর” থেকে গেলেও পুকুর পাড়ে একটিও তাল গাছ দাঁড়িয়ে নেই!শুধু নামেই “তালপুকুর”! গ্রামের মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নত হয়েছে কিন্তু তাল আর আগের মতো গ্রামের মানুষের কাছে সমান কদর পায় না!গ্রামের মানুষের মধ্যে হঠাৎ ঝুপ-ধপাস শব্দে খসে পড়া পাকা তাল কুড়ানোর বিশেষ এক ঝোঁক ছিল! কেউ কেউ তাল খেতে পছন্দ করে না,তবুও তাল কুড়োনোর নেশা গ্রামের প্রায় সব শৈশবকে আকৃষ্ট করত!ছোটোবেলায় তাল কুড়োনোর কাহিনী-গল্প কয়েকটি পূর্ব প্রজন্মের কাছে আজও ছেলেবেলার স্মৃতি—নস্টালজিক!পাকা তালের ব্যবহার এখন বিশেষ ধর্মীয় সংস্কার,রীতি-অনুষ্ঠানে সীমিত হয়ে গেছে!তাল পরিপাক করার ক্ষমতা বোধহয় গাঁয়ের মানুষের হ্রাস পেয়েছে!তবে এখনো গ্রামে গ্রামে তাল উৎসব হয়—বর্ষার খাদ্য উৎসব—তালপিঠে পার্বণ;তাল সম্পর্কিত কিছু গ্রাম্য লোকাচার-সংস্কার,পার্বণ-ব্রত—তালনবমী,ক্ষীরপিঠা পালন হয়ে থাকে ফি-বছর শ্রাবণ-ভাদ্রে।ব্রত পালন উপলক্ষে গ্রামের ঘরে ঘরে তালের পিঠে খাওয়ার নেমন্ত্রন আসত,এখন ম্লান—সেই নেমতন্ন করে পাত পেড়ে খাওয়ানোর সুন্দর প্রথাটি ক্রমশ গ্রাম্য সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে!আর্থ-সামাজিক অত্যাধুনিক উন্নয়ন হলেও সৌভাতৃত্ব-কুটুম্বতা-আত্মিক সম্পর্ক গুলো বোধহয় দিনে দিনে কেমন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে! প্রত্যক্ষ পাকা তালের মাড়ি না খেলেও টিপটিপ বর্ষা দিনে তালের ফুলুরি; তালের বড়া;তালের পিঠে—সরু চাকলি(মেলা),পাত পিঠে(শাল বা কলা পাতায় মোড়া পিঠে);তালের লুচি(ঘাংরা),তালের পায়েস-তালসত্ত্ব কে না খেতে ভালোবাসে!
গ্রামে শৈশব কেটেছে,তাই অনেকের মতো আমার কাছেও ছোটবেলায় তাল কুড়োনো ছিল একটা নেশা—আনন্দ-ঝোঁক!হতে পারে অনেকের কাছে ব্যাকডেটেড কিন্তু আমার কাছে নস্টালজিক!গ্রাম্য শৈশবের আবেগ।তাল খাওয়ার চেয়ে তাল কুড়োনোতে বেশ আনন্দ ছিল!গ্রামের প্রায় সব ছেলেরা তাল কুড়িয়ে আনন্দ পেত!রাঢ় বাঁকুড়ার প্রায় প্রতিটি গ্রামে শ্রাবণ-ভাদ্রের বিশেষ তিথি-বারে তালের ক্ষীরপিঠা পালা-পার্বণ পালিত হয়,তাই ওই দিন গুলোতে গ্রামের ঘরে ঘরে তালের বিশেষ চাহিদা থাকে।গ্রামের কিশোর-বালক’রা খুব ভোর ভোর উঠে টর্চ-লন্ঠন হাতে নিয়ে তালতলায় হাজির হতো তাল কুড়ানোর জন্য।সব তাল স্বাদে সমান নয়।তালের প্রকারভেদ আছে।মিশ কালো তাল জাতে সেরা।আকারে বড়ো,তাই অনেকে বলে মিশ কালো হেঁড়ে তাল।সাদা অথবা হলদে তাল হল কটা তাল—আকারে ছোট,স্বাদে কখনো হয় তেতো।প্রকৃতির ফলহীন মরশুম ভাদ্রে —তাল বিভিন্ন পশু-পাখি এবং বাদুড়েরও খাদ্য তালিকায় থাকে। তাল পড়ার “ঝুপ-ধপাস” শব্দটি সেইসময়কার কিশোরদের একটা দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিত।পুকুরে তাল কুড়ানোর প্রতিযোগিতা ছিল আরও মজাদার—জলে পড়া তাল পুকুরে লাফ দিয়ে সহজে কেউ ধরতে পারত না।তবে শক্তিশালী দূরন্ত কিশোরটি শেষ পর্যন্ত জিততো এবং তাল কুড়িয়ে ভেজা জামা কাপড়ে বাড়ি ফিরতো।হয়তো ঘরে ফিরে পিঠে পড়ত দুই-চার ঘা—হাতের ছাপ,কপালে জুটত বকুনি!তাল গাছের মালিক না হলেও পাকা পড়া তাল যে কুড়োবে তালের মালিক সেই হবে।কেউ কেউ ছেলেবেলায় মজারছলে অন্যকে ঠকানোর জন্য হঠাৎ একটি লাঠি দিয়ে ভেজা মাটিতে আঘাত করত অথবা তাল গাছে ঢিল ছুঁড়ে দিত —অনেকেই তাল পড়েছে ভেবে তাল কুড়ানোর জন্য তাল তলায় দৌড়ে আসত এবং তাল তলে লুকিয়ে থাকা অন্য দলটি হো হো করে হেসে উঠত।এখন আর কেউ তাল তলায় যায় কিনা সন্দেহ আছে!কারণ গ্রামের হাটে তাল কিনতে পাওয়া যায়।

ছেলেবেলার এক গল্প বলি—শ্রাবণ সংক্রান্তি,গ্রামের এক পাড়ায়—রাত্রে মাখল পরবের(শ্রমজীবি প্রান্তিক মানুষের মনসা পুজো) ঢাক-মাইক বাজছে,সারারাত মূষলধারে বৃষ্টি,ডোবা-পুকুরে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর কনসার্ট।মাঠ-ঘাট,ডোবা-পুকুর জল থৈ থৈ করছে চারদিকে জলে সাদা হয়ে গেছে।দূরে মাঠের মাঝে শাল বাঁধে জল নামার শব্দ হো হো করে ভেজা বাতাসে ভেসে আসছে।মায়ের পাশে শুয়ে আছি,বৃষ্টি ঝরার শব্দ শুনছি,বিনিদ্র চোখ দুটো শুধু বুজে আছে!মনে মনে তাল কুড়ানোর নেশায় ভোর হওয়ার অপেক্ষায় জেগে আছি।সংসারে সারাদিনে প্রচন্ড খাটুনি থাকে, মা ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছেন!ভোর হতে তখনও বাকি,সবে বাদলা মেঘে ঢাকা পুব আকাশে হালকা আলোর আভা।আমি অতি ধীর পায়ে মায়ের আঁচল ডিঙিয়ে চুপি চুপি সদর দরজার খিল খুলে বেরিয়ে পড়েছি তাল কুড়োতে। তবে বাড়ির পাশের তাল তলায় নয় কারণ রাত্রেই ওই গাছের তাল কেউ না কেউ কুড়িয়ে নেয়। বুড়ির পুকুরেও নয়,বুড়ির পুকুরে যাওয়ার সাহস ওই বয়সে আমার ছিল না। বুড়ির পুকুর—কয়েকশো তাল গাছে ঘেরা পুকুর,দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার থাকত।আমার কেমন যেন গা ছম ছম করত।সবাই বলতো বুড়ির পুকুরে ভূত আছে,শাকচুন্নি আছে,ব্রহ্মদৈতি আছে—অনেকেই নাকি দেখেছে!শিশু মনে বিচার করার ক্ষমতা ছিল না,তাই সহজেই বিশ্বাস করে নিতাম।ভয়ে কোনোদিন বুড়ির পুকুরে পা বাড়ায়নি।ওইদিন ভোরে টিপ টিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে হালদারদের তাল তলায় তাল কুড়োতে গেছি,সেই সময় ছিল না কোনো ভয়ডর—-শুধু তাল কুড়ানোর নেশা আর আনন্দ!তাল কুড়িয়েছিলাম এক সাথে ৯টা,মিশ কালো হাঁড়ি তাল।পিছনে পিছনে কখন এসেছে পাশের বাড়ির ভম্বল। আমি আগে আসায় তাল আমার হাতেই এসেছে। কিন্তু ভম্বল একটি তালও কুড়োতে পারেনি,আমি কুড়িয়ে নিয়েছি সব।ভোরের আলোয় ভম্বলের বৃষ্টিভেজা চোখে জল দেখেছিলাম,দেখেছিলাম ওর মন খারাপের অভিব্যক্তি।ওর তাল না পাওয়ার আফসোস দেখে আমারও কেমন মন খারাপ হয়ে গেল।আমি ভম্বল কে চারটে তাল দিয়েছিলাম এবং আমি পাঁচটা তাল হাতে,বগলে চেপে কোনো রকমে ধরে—-দুইজনে কাদা রাস্তার উপর দুই জোড়া ছোট ছোট পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে ভোরের আলো মাখা বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফিরে এলাম। ঠিক যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “তালনবমী” গল্পের দুই ভাই নেপাল-গোপালের মতো আমি আর ভম্বল তাল কুড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম!উঠোনের ভেজা জলপিড়িতে তাল গুলো নামানোর সাথে সাথে বাবা এবং দাদার একসাথে বকুনি দেওয়া কন্ঠস্বরে আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভেজা শরীরে কাঁপছি,মা তখন রান্নাঘরে।তারপর থেকে আর তাল কুড়োতে যাওয়া হয়নি আর এখন তো বড়ো হয়ে গেছি।তবে গাঁয়ের তাঁতিপাড়ার ভৈরব কাকু(ঁভৈরব চন্দ) আমাদের ভালোবাসতেন,ঘরে ডেকে তাল দিতেন অথবা ঘরে দিয়ে যেতেন।যাই হোক তাল কুড়োনো ছিল এক নেশা-গ্রামের ছেলে মেয়েদের এই তাল কুড়ানোর অভিজ্ঞতা-অনুভুতি নিশ্চয় আছে!

কলমেঃ উজ্জ্বল সাউ (ছবিটি:শহরতলীর এক গাঁয়ের বধূ পথের ধারে তালতলা থেকে তাল কুড়িয়ে ফিরছেন।)

About Prabir Mondal

Check Also

কার্তিক লড়াইকে ঘিরে জমজমাট কাটোয়া

রাহুল রায়, কাটোয়াঃ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের সকলের কাছে সব থেকে বড় পুজো হল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *