টুডে নিউজ সার্ভিসঃ পূর্ব বর্ধমান জেলায় আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত খড়ি নদী-কে দেখলে কবিগুরুর এই কবিতার পঙক্তিগুলি মনে পড়ে। পূর্ব বর্ধমানের খড়ি নদী এমনই এক নদী, যার পরিচয়ে লৌকিক মাহাত্ম্য কাহিনী, জনশ্রুতি এবং ভৌগোলিক বর্ণনা মিলেমিশে একাকার। পূর্ব বর্ধমান জেলার বুদবুদ থানার মানকর অঞ্চলের মাড়ো গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে এক জলাশয় থেকে উৎপত্তি লাভ করে খড়ি নদী প্রায় ১৪০ কিমি দীর্ঘ পথ প্রবাহিত হয়ে ধাত্রীগ্রামের কাছে ভাগীরথী নদীতে মিলিত হয়েছে। উর্দ্ধপ্রবাহে খড়ি নদী খালের মতো শীর্ণকায় হলেও, নিম্নপ্রবাহে এই নদী ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গোপভূমে খড়ি নদী এক বিশিষ্ট নদীর স্বীকৃতি পেয়েছে। কারন এই অঞ্চলে অজয় ও দামোদরের পর একমাত্র খড়ি নদীই সরাসরি ভাগীরথীতে মিশেছে এবং খড়ি নদীর সাথে এক লৌকিক মাহাত্ম্য জড়িয়ে রয়েছে।
খড়ি নদীর উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত জনশ্রুতি হল, কালাচাঁদ গোঁসাই নামে এক নিঃসন্তান শাক্ত ব্রাহ্মণ পূজা করে দেবী মহামায়াকে সন্তুষ্টা করেন। দেবী বালিকা রূপে প্রকট হন, যার গায়ের রঙ খড়ির মতো সাদা। দেবী ব্রাহ্মণের বাড়ি এলেও, ব্রাহ্মণী উচ্ছিষ্ট খাবার দেওয়াতে একসময় দেবী ব্রাহ্মণের বাড়ি ত্যাগ করে চলে যেতে থাকেন। ব্রাহ্মণ দেবীকে নিবৃত্ত করতে পিছনে ছুটতে থাকেন। অবশেষে ধাত্রীগ্রামের নিকট দেবী ভাগীরথীতে ঝাঁপ দেন। দেবী যে পথে গিয়েছিলেন, তাই নদীর গতিপথ হয়ে যায়। আর দেবী ডাইনে-বামে এঁকেবেঁকে গিয়েছিলেন, তাই খড়ি নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা। খড়ি নদীর উৎপত্তি স্থলে একসময় দেবী খড়্গেশ্বরীর মন্দির ছিল। এখনও পৌষ সংক্রান্তিতে খড়ির নদীর উৎসস্থলে নামকীর্তন হয়।
পূর্ব বর্ধমান জেলার খড়ি নদীটি উৎসস্থল থেকে প্রথমে গলসি ও ভাতার থানার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর পারুই- ভান্ডারডিহি মন্তেশ্বর সিঙ্গি-নিমদহ হয়ে ধাত্রীগ্রামের কাছে ভাগীরথী নদীতে মিশেছে। খড়ি নদীর প্রধান উপনদী হল বাঁকা নদী। খড়ি নদী অববাহিকাটির আয়তন ১২০৭ বর্গকিমি, যা পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি ১, গলসি ২, বর্ধমান, ভাতার, মন্তেশ্বর, কাটোয়া ১, কাটোয়া ২, পূর্বস্থলী ১, পূর্বস্থলী ২, আউশগ্রাম ১ ও আউশগ্রাম ২ ব্লকে বিস্তৃত রয়েছে। তবে ডিভিসি ক্যানেল নির্মাণের ফলে খড়ি নদীর উৎস অংশের উচ্চভূমির ধারণ অববাহিকা হ্রাস পেয়েছে। ফলে খড়ি নদীতে জলের জোগান কমেছে, নদী হয়েছে শীর্ণ। তবুও, আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত খড়ি নদীর তীরে স্থানে স্থানে সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রয়েছে, যেখানে রাঢ় বাংলার প্রকৃতির অনুপম ছবি ফুটে ওঠে।
শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, খড়ি নদীর দ্বারা দু’পাড়ের গ্রামগুলির মানুষ উপকৃতও। গ্রীষ্মে যেমন খড়ির জল কমে হাঁটু সমান হয়ে যায় তেমন বর্ষার সময় দু’কূল ছাপিয়ে বন্যাও হয়। তবে খড়ির বন্যায় খুব একটা ক্ষয়ক্ষতির কথা শোনা যায় না। বরং দু’পাড়ের জমিতে পলি পড়ে চাষের কাজে উপকার হয় বলেই জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। আবার গ্রীষ্মের সময় স্যালোর মাধ্যমে খড়ি থেকে জল তুলে কৃষিকাজ করা হয়। একটা সময় ছিল, যখন খড়ি নদীতে মাছ ধরেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীতে অবশ্য মাছের পরিমাণ কমতে থাকে। যদিও, দূষণে ধীরে ধীরে নিজস্বতা হারাচ্ছে খড়ি নদী। বর্তমান অবস্থা খুব ভালো নয়। কখনো কখনো মন্তেশ্বর, নাদনঘাট এলাকায় খড়ি নদীর বন্যাতে সবজি চাষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। গ্রীষ্মের শুষ্কতা হোক বা বর্ষার প্লাবন, খড়ি বেঁচে থাকবে তার নিজস্ব জনশ্রুতি, লৌকিক মাহাত্ম্য ও ইতিহাস নিয়ে।
Social