Breaking News

সাত সমুদ্র তেরোনদীর পাড়ে “বার্লিনের বাঙালি”র দুর্গাপুজোয় এবার দমদম পার্কের দীপঙ্কর দত্তের ফাইবার ক্যাস্টিং মূর্তি

 

টুডে নিউজ সার্ভিস, দমদমঃ উমা এখন কৈলাশে সংসার সামলাচ্ছে ছেলেমেয়ে স্বামী সবকিছুই নিয়ে।‌ উমার বাপের বাড়ি আসতে এখনও দুইমাস দেরি। কিন্তু ইতিমধ্যেই মেয়ে বাপের বাড়ি আসার দিনক্ষণ দেখে ফেলেছে আপামর বাঙালি তথা সব জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষজন। কারণ, বছরের ওই একটা সময়েই চারটে দিন বাঁধনছেড়া আনন্দে মেতে উঠতে চান সকলেই। হাত গুটিয়ে বসে নেই পটুয়া পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তবে কেবল পটুয়া পাড়ার শিল্পীরাই নয়, এই সময় অনেক বিখ্যাত শিল্পীরাই আছেন যাঁরা নিজেদের শিল্পকর্মকে ফুটিয়ে তোলেন মা দুর্গার প্রতিচ্ছবির মধ্যে দিয়ে। ঠিক সেই রকমই এক শিল্পী যিনি থাকেন দমদম পার্কে, গতমাসেই তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে। তাঁর তৈরী মা দুর্গা এবার পাড়ি দিতে চলেছে সাত সমুদ্র তেরোনদীর পাড়ে সুদূর জার্মানির বার্লিনে। সম্পূর্ণ ফাইবার ক্যাস্টিং এর তৈরী করা এই মূর্তি রীতিমতো সকলকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবারের দুর্গাপুজোয়। 

দমদম পার্কের দীপঙ্কর দত্ত জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জে। দেশভাগের সময় ১৯৭১ সালে বাবা-মার হাত ধরে চলে আসা এপার বাংলায়। দুই দাদা বৌদির সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা একান্নবর্তী পরিবারে সেদিনের দীপঙ্কর বাবু বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও শখ ছিল শিল্পকর্মে আর সেখান থেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান শান্তিনিকেতনে। সেলিম মুনসি ও সোমনাথ হোড় তাঁকে বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করে তুই বিশেষ কোনো একটা কিছু করতে পারবি না। তাই অগত্যাই শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে দমদমে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি আর সেখান থেকে পাশ করার পর ওই ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজেই শুরু করেন অধ্যাপনা। ১৯৮৫ সালে প্রথম বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল তার ঠাকুর সুদূর আমেরিকায়, তারপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। আমেরিকা, কানাডা সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর তৈরি করা ঠাকুর ইতিমধ্যেই সকলের যেমন নজর কেঁড়েছে ঠিক সেরকমই তিনি পেয়েছেন অনেক সম্মানও। যোগাযোগটা ঘটেছিল প্রথম মার্চ মাসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্যটা ছিল একটাই, দালাল চক্রের হাতে পড়ে যাওয়া। ছোট থেকে জেদ আর ভালবাসা কে জয় করে দীপঙ্কর বাবু এবারেও দালাল চক্র থেকে বেরিয়ে নিজেই যোগাযোগ সুদৃঢ় করে জার্মানির বার্লিনে ফাইবার কাস্টিং এর ঠাকুর পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে শুধু বিদেশ নয় নিজের দেশের প্রায় সব প্রান্তেই গড়েছেন তাঁর এই শিল্পকর্ম, এমনকি শহর কলকাতাতেও অনেকবারই নিজে হাতে তৈরি করেছেন মা দুর্গাকে যা স্থান পেয়েছিল শহর কলকাতার বিভিন্ন নামীদামি মণ্ডপে। ছোট থেকেই ছিল দীপঙ্কর দত্তর অদম্য জেদ আর ভালোবাসা কিন্তু চোখে ছিল না কোন স্বপ্ন তাই নিজের জেদ কে বজায় রাখতে গিয়ে ২০১১ সালের পর থেকে শহর কলকাতায় আর কোনো ঠাকুর তৈরি করেন না একটা কারণেই, কলকাতায় ঠাকুর গড়ে দেওয়া যায় কিন্তু অর্ধেকের বেশি পয়সাই কেউ দিতে চায় না ফলে তাঁর সহযোগী যে ৬-৭ জন ছাত্র-ছাত্রী তাঁর সঙ্গে কাজ করেন তাঁদের মজুরি দিতে হয় নিজের পকেট থেকেই, সে কারণেই দীপঙ্কর বাবু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেদিন পুরো টাকা হাতে পাবেন সেদিনই ফের কলকাতায় আবারও মা দুর্গার প্রতিমা গড়বেন। তবে এবার সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় জার্মানির বার্লিনে নিজের শিল্পকর্মকে পাঠাতে পেরে রীতিমতো আনন্দে আত্মহারা দমদম পার্কের দীপঙ্কর বাবু। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিল্প সংগঠনে একটা বিশাল সুখ্যাতি আছে তাঁর, সেই জায়গা থেকেই দীপঙ্কর দত্ত কেবলমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসাতেই নয় রীতিমতো দিনরাত এক করে প্রায় তিনমাস ধরে এই ঠাকুর তৈরী করেছেন নিজের হাতেই। 

অন্যদিকে জার্মানিতে যে সমস্ত বাঙালিরা থাকেন তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তা করছিলেন সেখানে দুর্গা পূজা করা যায় কিনা, আর যা ভাবা সেই কাজ। এবার জার্মানির বার্লিনে পনেরোটি বাঙালি পরিবার মিলে শুরু করতে চলেছেন দুর্গাপুজোর। বার্লিনে বাঙালিরাই এবার প্রথম দুর্গাপুজো করছেন এমনটাই দাবী করেছেন অরিজিৎ পাল, যিনি “বার্লিনের বাঙালি” নামক যে সংস্থা তৈরী হয়েছে তার সর্বময়কর্তা। সেই অর্থে যেহেতু এটা প্রথম বছর তাই তাঁদের জায়গা সংকুলান হওয়ার কারণে বার্লিনে যে রাধা গোবিন্দের মন্দির আছে সেখানেই তাঁরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে স্থির করেছেন এবারের দুর্গা পুজো করবেন ওই জায়গায়। শুধু তাই নয় একের পর এক চমক রীতিমতো আপনাদের সকলকেই তাক লাগিয়ে দেবে এক মুহূর্তে। রাধা গোবিন্দের মন্দির মানে বৈষ্ণব ধর্মের স্থান আর সেখানেই হবে শাক্ত মতে দুর্গাপুজো। এই পনেরোটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারে আছেন ডঃ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য্য, যিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সাইন্টিস্ট, তিনিই এবার পুরোহিত আর তিনিই পুজো করবেন এবার সুদূর বার্লিনে পঞ্জিকা মতে এবং নিয়ম মেনে। অরিজিৎ পাল অবশ্য জানালেন সেখানে দুর্গাপুজো করার উদ্দেশ্য একটাই। ছোটবেলায় কলকাতায় দুর্গাপূজোর সময় তাঁরা যে আনন্দ করতেন পরবর্তী প্রজন্ম যাতে জানতে পারে এটা আমাদের নিজেদের একটা ঐতিহ্য, তাই ওরা যাতে এটাকে ধরে রাখতে পারে এটা যাতে কোনমতেই তাঁরা মিস না করে সে কারণেই এই দুর্গাপুজো করা। ভাবছেন এখানেই শেষ একেবারেই নয়, বাঙালি মুসলমান তিনিও ওখানে গিয়ে ঠাঁই পেয়েছেন বার্লিনে আর এবার দুর্গা পুজো হবে কিন্তু সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে না এটা হতে পারে না। বার্লিনের দুর্গাপুজোয় এবার ওই বাঙালি মুসলমান ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার রীতিমতো এখন থেকেই মহড়া শুরু করে দিয়েছেন সকলকে নিয়ে পুজোর চারদিন কি কি অনুষ্ঠান হবে। রীতিবতো নিয়ম করে প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে সকলেই যোগ দিচ্ছেন সেই মহড়ায়। দুর্গাপুজোয় পেটুক বাঙ্গালী কি চুপ করে বসে থাকতে পারে? ভাবলেও অবাক হয়ে যেতে হয়, সুদূর বার্লিনের মতো একটা জায়গায় ভারতবর্ষ থেকে গিয়ে ওখানে যাঁরা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছেন তাঁরা এগিয়ে এসেছেন “বার্লিনের বাঙালি” সংস্থার কাছে। মেনু তৈরী করেছেন অরিজিৎ বাবুদের ওই পনেরোটি পরিবার। সপ্তমী থেকে দশমী যেই আসবেন তাঁদের পুজো দেখতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁদের জন্য থাকছে বিভিন্ন খাবারের আয়োজন একেবারেই বিনামূল্যে। খুব সহজেই তাই এখন থেকেই বুঝতে পারছেন সাত সমুদ্র তেরোনদীর পাড়ে “বার্লিনের বাঙালি”র এবারের দুর্গাপুজো যে কত বড় আকার ধারণ করতে চলেছে। যাঁদের প্রথম বছরের দুর্গা পুজোতেই এতো বড় চমক আগামী দিনে এই দুর্গা পুজো যে কত বড় আকার নেবে গোটা বিশ্বজুড়ে সেটা একপ্রকার সকলের কাছেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। শেষে অবশ্যই একটাই কথা বলতে হয়, “আসছে উমা আসছে আবার আসছে নিজের ঘরে, আসছে শরৎ মাতিয়ে জগৎ একটি বছর পরে।”

About Burdwan Today

Check Also

সৃজনী প্রেক্ষাগৃহে আর্ট ওয়ার্কশপ

টুডে নিউজ সার্ভিস, দুর্গাপুরঃ ‘ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে, চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *