রমা চ্যাটার্জি, দক্ষিণ দিনাজপুরঃ সম্মান নাকি কুসংস্কার! ইতিহাসকে ঘিরে জনশ্রুতিতে বিশ্বাসী হয়ে কুসংস্কারে এখন পর্যন্ত কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে কেউই ঘুমোননা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের বেলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পীরপাল গ্রামের গ্রামবাসীরা। কাঠের নয় মাটির তৈরি ঢিপিতে অথবা মাটিতে ঘুমোন গ্রামবাসীরা।
এলাকার গ্রামবাসী ও ইতিহাসবিদের মুখে শোনা যায় ১৭০৭ সালে পিরপালের মাটিতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর দেহ সমাধিস্থ করা হয়। এর পর তিনি দেবতা পীর রুপে আবির্ভূত হন বলে বিশ্বাস গ্রামবাসীদের। বীর যোদ্ধাকে মাটিতে সমাধিস্থ করার পর থেকে গ্রামবাসীরা কাঠের তৈরি খাটে বা চৌকিতে ঘুমোলে তাদের স্বপ্নাদেশে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এইভয়ে বিগত কয়েকশো বছর থেকে পিরপালের গ্রামের মানুষ কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমোন না। আর কেউ যদি কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমোন তাহলে সেই পরিবারের সকলে অসুস্থ হয়ে পরে। এমনটাই মত গ্রামবাসীদের। তবে ইতিহাসবিদের দাবী বখতিয়ার খলজীকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রামবাসীরা মাটিতে ঘুমোন।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর, তপন, হরিরামপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গঙ্গারামপুর এলাকার পীরপাল অন্যতম। জেলার ইতিহাসবিদ ও স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানায় ১৭০৭ সালে সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বখতিয়ার খলজী পাল বংশের লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সংগ্রামপুর, দেবী কোর্ট সহ গোটা গৌড় দখল করে নেন। লক্ষ্মণ সেন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে তৎকালীন বঙ্গে পালিয়ে যান এবং তার সৈন্যরা পরাজিত হয়ে নদিয়া শহর পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
অন্য দিকে এরপর বখতিয়ার খলজী তিব্বত ও কামরুপ অভিযানে যান। সেখানে বিফল হয়ে বখতিয়ার খলজী দেবীকোটে ফিরে আসেন। তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে শুরু করে। এরই ফলে বাংলার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দিল্লির সাথে সম্ভাব্য বিরোধে আগে থেকেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এরকম নানাবিধ চিন্তা, এবং পরাজয়ের গ্লানিতে বখতিয়ার খলজি প্রচন্ড ভাবে অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পরেন। এর অল্প কিছুদিন বাদে বাংলার ১২০৬ বঙ্গাব্দে ও ইংরেজীর ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। কেউ কেউ অনুমান করেন যে বখতিয়ারের খলজীর মৃত্যুর পিছনে তার প্রধান সেনাপতি আলীমর্দান খলজীর হাত ছিল। এরপর বখতিয়ারের মৃতদেহ পীরপালে সমাধিস্থ করা হয়।
যেহেতু তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন তাই তিনি ভগবান পীর রুপে আবির্ভূত হন বলে গ্রামবাসীদের মত। তার পর থেকে এলাকার বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ কাঠের তৈরি চৌকিতে বা খাটে ঘুমোন না। গ্রামবাসী নাটারু রায় জানান, চৌকি বা খাটে ঘুমোলে স্বপ্নাদেশে তাদের ভয় দেখানো হয়। বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে তারা গল্প শুনে আসছে রাতে চৌকি বা খাটে শুলে স্বপ্নে ঘোড়া ছোটার আওয়াজ পাওয়া যায়। খাট থেকে ফেলে দেয়। আর এরপর সেই পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পরে। তাই তারা কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমোন না বা কাউকে ঘুমোতে দেন না। এই পীর বাবাকে ভগবান রুপি মেনে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে বড় করে মেলা বসে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দেখতে আসেন কিন্তু বর্তমানে দরগাটির করুণ দশা। সরকার থেকে পর্যটন কেন্দ্র করা হবে বললেও আজও কোন হেলদোল নেই। ধীরে ধীরে ভগ্নদশায় পরিণত হচ্ছে পীরের দরগা।
তবে এই বিষয়ে ভিন্ন মত প্রসন করেন জেলার ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ। তিনি বলেন তিব্বত ও কামরুপ অভিযানের পর বখতিয়ার খলজী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তার সেনাপতি আলীমর্দান খলজীর হাত নিহত হন। যেহেতু তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন তাই তাকে সম্মান জানাতেই পীরপালের মানুষ মাটিতে ঘুমোয়। তবে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে। যেহেতু বীর যোদ্ধা বখতিয়ার খলজী পীরপালের মাটিতে শায়িত আছেন তাই গ্রামবাসীরা কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমোন না। তিনি আরো জানান ইতিহাসকে ঘিরে পিরপাল সহ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এখানে একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। সরকারের এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।
এই বিষয়ে পীরপাল গ্রামের এক গৃহবধূ পিঙ্কি দেবশর্মা বলেন, আমরা মাটিতে শুই। কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে গ্রামের কেউ ঘুমোয় না। বখতিয়ার খলজীকে পীর বাবা মানার কারনে গ্রামের মানুষ আজও মাটির তৈরি “উঁচু ঢিপি বা খাটে” ঘুমায়।
বিজ্ঞানের যুগে এমন ঘটনাকে বাহিরের দুনিয়া কুসংস্কার বললেও পীরপাল গ্রামের মানুষ ভয়ে বা শ্রদ্ধায় বংশ পরম্পরায় মেনে চলেছে এই প্রথা।
Social