অশোক মজুমদারঃ এবারের একুশের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্দান্ত ফলের পিছনে পিকে অর্থাৎ প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা এখন সবার মুখে মুখে। ঊনিশের লোকসভার ফল আশানুরূপ না হওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিকের সংস্থা আইপ্যাকের সঙ্গে চুক্তি করেন।
অনেকে এই সিদ্ধান্তে দারুন খুশি হয়েছিলো, অনেকে নয়। আমি নিজেও একটু সন্দিহান ছিলাম। কেউ কেউ অভিযোগও করতো যে দল মানে আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততা। দলকে কর্পোরেট ধাঁচে বাঁধতে চাইলে মানুষের থেকে নাকি দূরে চলে যাবে। আমি ভালোমন্দ সবই শুনতাম। কিন্তু মনে মনে ভরসা ছিলো দিদির সিদ্ধান্তের। কারণে ওনার দূরদৃষ্টিতাই ওনার সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই ভাবতাম দিদি যখন আছেন তখন, “জয় মা বলে ভাসা তরী।”
সত্যি বলতে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফল বাংলার রাজনৈতিক ভবিষ্যতে কালো মেঘ জমিয়েছিলো। বিজেপি আঠারোটা সিট দখল করে এমন দাপাদাপি শুরু করেছিলো যে একুশের বিধানসভা পর্যন্ত বর্তমান সরকার আদৌ টিকবে কি এমন প্রশ্নও উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো মিডিয়ায়। রাজ্যজুড়ে প্রায় তান্ডবনৃত্য শুরু করেছিলো বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর চিরচেনা সাহস আর সুনেতৃত্বে বেশ কয়েকমাসের চেষ্টায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিলো।
ঠিক এই জায়গা থেকেই পিকে কাজ শুরু করেছিলো। পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, নানা অভিনব ভাবনা নিয়ে তৃণমূল মানুষের কাছে পৌঁছেছিলো। দলীয় নেতাকর্মীদের আবেগকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠ পরিকল্পনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। আর সেই সুতোর ধরতাইটাই ধরিয়ে দেবার কাজ করেছিলো আইপ্যাক।
ফলাফল আজ সারা দেশকে চমকে দিয়েছে। ২রা মের দিনই প্রথম আমি পিকেকে একটু খোলামেলা দেখলাম। তার আগে ওকে যতবারই দেখেছি, ও চেয়ারে চুপচাপ বসে মোবাইলে মগ্ন থাকতো। কিন্তু পরে পরে বুঝেছিলাম ও অত্যন্ত সভ্য ভদ্র মানুষ। ধীরে ধীরে কথা বলে। কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক চরিত্র ওর নখদর্পণে। যে কারণেই বোধয় ভোট কৌশলী হিসেবে পিকে রাজ্যে রাজ্যে এতো সফল।
এবারের ফল প্রকাশের কয়েকদিন পর আইপ্যাকের কর্মীরা দিদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। দেখলাম সবাই নতুন প্রজন্ম। ওদের মধ্যে আমাদের বাংলার ছেলেমেয়েও ছিলো। দিদির সঙ্গে বসে ওরা নানা আলোচনা করলো। প্রশ্ন উত্তর নিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় ওরা ছিলো কালীঘাটে। সেদিন একটা জিনিস খেয়াল করেছিলাম, ছোটোরাও বর্তমান যুগ, কাল, পরিস্থিতি সম্মন্ধে যথেষ্ট সচেতন। রাজনীতির ক্ষেত্রে ওদের মতামতটাও ভীষণ জরুরী। আর দিদি নিজে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন বলে ইয়ং জেনারেশনদের পড়তে পারেন দারুন। ফলে ওরা খুব খুশি হয়েছিলো দিদিকে সামনে পেয়ে। এবার তো আইপ্যাক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে চব্বিশের লোকসভা ও ছাব্বিশের বিধানসভা পর্যন্ত কাজ করবে। খুব ভালো হয়েছে এটা।
বর্তমান ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সংকট চলছে। সঠিকভাবে দেশকে পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠছে দিনদিন। যে স্বপ্ন দেখিয়ে ওরা ক্ষমতায় এসেছিলো তা আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী দলগুলিকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছেন। কারণ চব্বিশে এই দানব মনুষ্যত্বহীন দলটিকে গদি থেকে না সরাতে পারলে দেশ ডুবে যাবে অন্ধকারে। সেই ভয়াবহ পরিণতির আশংকা করেই বিরোধীদের জোট বাঁধতে বলছেন তিনি। নিজেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দলের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির দায়িত্বভার তুলে দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর।
এটা প্রয়োজন, কারণ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি যোগ্য প্রধানমন্ত্রীর অভাবের ফলে দেশ ভুগছে নেতৃত্বহীনতায়। গত সাত বছর ধরে নরেন্দ্র মোদীর একতরফা জনবিরোধী সিদ্ধান্তগুলোয় ভারতবর্ষ আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের মত গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে ভয় পায়। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একমাত্র ব্যতিক্রম। আর একুশের এই ফলাফল তো সারা দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সামনে একটি পরিস্কার বার্তা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এই মুহূর্তে দেশকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতম মুখ। উনিই এই একনায়ক শাসনকে রোখার ক্ষমতা রাখেন।
এই ভাবনা দেশের সব বিজেপি বিরোধী দলকে ভাবতে হবে। ফলাফল কি হবে না হবে সেটা ভবিষ্যত বলবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ব্যক্তিত্ব যিনি অনেকটা জিয়ন কাঠির মত। যাঁর স্পর্শে প্রাণ ফিরে আসে। বাংলায় তা প্রত্যক্ষ করছি আমরা। তাই এদেশেরও মরা গাঙে তিনিই একদিন বান নিয়ে আসবেন এই আশা করাটা মোটেও অবাস্তব নয়। আর স্বাধীনতার এতোবছর কেটে গেলেও অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলা থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হয়নি। সেই জায়গায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হলে তো আমাদের কাছে গর্বের বিষয়।
এবার তাই শুরু হোক পথ চলা….নতুন ভাবনায়, নতুন ভারতের লক্ষ্যে। সঙ্গে থাকুক দেশের আপামর জনগন, অন্যান্য দল, সঙ্গে থাকুক আইপ্যাকের তরুণ তরুণীদের সাজানো গোছানো পরিকল্পনামাফিক সহযোগিতা ও মাথার উপর সর্বাগ্রে দিদির অভিজ্ঞতা। এইসব নিয়েই শুরু হোক নতুন ভারত গড়ার কাজ।
চরৈবেতি চরৈবেতি…..
Social