ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ঃ “এমনিতে যারা দিব্যি বলেন বাঙালি এবং মুসলমান, ওমনিতে তারা গম্ভীরমুখে শান্তিমিছিলে হাঁটতে যান” – সুমনের এই গান কি শুনেছেন পাঠক? যদি নাও শুনে থাকেন, কথাটা কি অস্বীকার করতে পারেন? চারদিকে কান পাতলেই শুনবেন যে অক্লেশে বলা হয় “বাঙালি এবং মুসলমান”! এটা এবাংলার বাংলাভাষী মুসলমানদের অভিজ্ঞতা। সেই মৌসুমী ভৌমিকের গান আছে না, “এখানে তুমি সংখ্যালঘু/ ওখানে তুমি জমজমাট/ এখানে তুমি বস্তিবাসী/ ওখানে চষো রাস্তাঘাট/ এখানে তুমি ভয় পেয়েছ/ এখানে তুমি নিঃসহায়/ এখানে তুমি নাম হারানো/ ওখানে প্রিয় আমান ভাই…
কোথায় যেন মানুষ কাঁদে/ কোথায় যেন কাঁদছে হায়/ মানুষ বড় ভয় পেয়েছে/ মানুষ বড় নিঃসহায়।” মৌসুমী ভৌমিকের এই ‘সংখ্যালঘু’ গানের বার্তা প্রত্যক্ষ করা যায় আমাদের পড়শি দেশ বাংলাদেশেও। সেখানে আবার গল্পটার উল্টোপিঠ দেখা যায়; সেখানে বলা হয় “বাঙালি এবং হিন্দু”! আসলে বিষয়টা একই; একই ভাষার কিন্তু ভিন ধর্মের প্রতিবেশীকে না চেনা, চিনতে না চাওয়া! সামনেই মহরম। আর তাই মোটেই অবাক হবেন না যদি শোকের অনুষ্ঠান মহরম উপলক্ষে আপনার মেসেজ বক্সে “মহরমের শুভেচ্ছা” এসে হাজির হয়!
এরাজ্যে এই অচেনা বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে সহনাগরিকদের পরিচিত করানোর চেষ্টা যেসব লেখক নিয়মিত করেন তাঁদের অন্যতম হলেন খাজিম আহমেদ। সম্প্রতি হাতে এল খাজিম আহমেদের “পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা”-র দ্বিতীয় সংস্করণ।
বইটি “উদার আকাশ” প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক ফারুক আহমেদ।
সত্তরোর্ধ্ব খাজিম আহমেদ ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন মৌলানা আজাদ কলেজে, পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ফলে ইতিহাস শিক্ষায় প্রথাগত প্রশিক্ষণ তাঁর রয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানদের সম্বন্ধে পড়াশোনা। এই সবেরই যোগফল এই বইটি। এই বই প্রথম বেরিয়েছিল ২০১২ সালে, এটি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ।
সতেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত তিন শতাধিক পাতার এই বই নিঃসন্দেহে অনেক ভাবনার খোরাক যোগায়। ভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা পুনরাবৃত্তি রয়েছে। আলোচনার মূল সুর বাঙালি মুসলমান; সে-বিষয়েই সবচেয়ে বেশি লেখা। বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে যে আলোচনা শুরু তা থেকে শেষ অবধি এক উপেক্ষিত জাতিসত্তার প্রশ্ন তোলা হয়েছে। লেখক বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎগামিতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন : “ব্রিটিশ শাসকরা যতদিন পর্যন্ত ঐতিহ্যশালী ফার্সি এবং উর্দু ভাষাকে সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে, ততদিন পর্যন্ত মুসলমানরা বাংলার বিচার বিভাগ ও আইন সংক্রান্ত সরকারি কাজে প্রাধান্য রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের পর সরকারি কাজে বিশেষত বিচার বিভাগে ইংরেজি ভাষার প্রচলন শুরু হওয়ায় মুসলমানরা ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে থাকেন।” আবার এটাও ঠিক “ভাষা, শ্রেণি, বর্ণ এবং আর্থিক অবস্থা মুসলমানদের মুসলমান থেকেই পৃথক করে রেখেছিল। অশিক্ষা আর অজ্ঞতাহেতু ইসলামের মূলসূত্র থেকেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে। ঠিক হিন্দুদের মতোই ছিল বহু ভাগ বা শ্রেণি। ‘আশরাফ’ (অভিজাত) ‘আতরাফ’-এর সমস্যা তো ছিলই।” খাজিম আহমেদ-এর লেখা পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল ইতিহাসে এম এ পড়ার সময়ে পড়া দুটো বইয়ের কথা; একটি জয়ন্তী মৈত্রের লেখা মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল (১৮৫৫-১৯০৬), অন্যটি শীলা সেনের মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল (১৯৩৭-১৯৪৭)। দুটি পর্বের মুসলমান রাজনীতি আলোচনা করতে গিয়ে তাঁরা যে-সমস্ত দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন সে-দিকে খাজিম আহমেদও দৃষ্টি দিয়েছেন, তবে তাঁর আলোচনাক্ষেত্রের সময়পরিধি পূর্ববর্তী গবেষকদের তুলনায় অনেক বিস্তৃত। বস্তুত খাজিম আহমেদ তাঁর পূর্ববর্তী গবেষণা/ আলোচনা কত খুঁটিয়ে পড়েছেন তা বোঝা যায় বইয়ে উল্লেখিত বিস্তৃত সূত্রনির্দেশ দেখলে; বই তো বটেই, তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রচুর প্রবন্ধও ব্যবহার করেছেন। তবে এই বইয়ের বিশেষত্ব হল যে এই বই শুধু প্রচলিত তথ্য আর তত্ত্বের সমাহার নয়। পাশাপাশি যুক্ত লেখকের সংবেদনশীলতা।
সাম্প্রদায়িকতার শিকড় সন্ধান যেমন তিনি করেছেন তেমনই সওয়াল করেছেন সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। সেখানে স্পষ্ট করে লিখেছেন, “মুসলমান সমাজে অসাম্প্রদায়িক ধারাকে শক্তিশালী করার বিষয়ে ‘সৎ এবং অসাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতৃত্ব’কেও সচেতন হতে হবে। পুরো সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের ঐক্য ভীষণ জরুরি। চিরাচরিত সামাজিক আনুগত্য আর সাম্প্রদায়িক আবেদনকে অস্বীকার করতে হলে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের উচিত, সমাজকে দ্বিধাহীনভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিকতা এবং ঐক্যের দিকে নিয়ে যাওয়া।”
মুসলমান সমাজে এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাঁরা লেখালেখি করেছেন, তাঁদের নিয়ে লেখা একটি অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়ে খাজিম আহমেদ স্মরণ করেছেন কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), রেজাউল করীম (১৯০২-১৯৯৩), সৈয়দ মুজতবা আলি (১৯০৪-১৯৭৪), হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯), আবু সৈয়দ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) প্রমুখের লেখালেখিকে। আবদুল ওদুদ সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ও বইতে রয়েছে। লেখক মুসলমান কথাসাহিত্যকদের সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন; তাঁদের মধ্যে সিংহভাগের কাজকর্ম সম্পর্কেই হয়তো আমজনতা ততটা অবহিত নন; ব্যতিক্রম সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মত দু’একজন। তবে অসাম্প্রদায়িক উদারমনা লেখক-সম্পাদক হিসেবে আবদুর রাউফ এবং সদ্যপ্রয়াত হোসেনুর রহমানের অবদান সম্পর্কে আলোচনা প্রত্যাশিত ছিল। আবদুর রাউফের চতুরঙ্গ এবং হোসেনুর রহমানের নবীনপত্র নিজগুণেই সমুজ্জ্বল। চতুরঙ্গ পত্রিকার কথা অবশ্য উল্লেখিত হয়েছে তবে সেটা হুমায়ুন কবির-আতাউর রহমানের সম্পাদনাপর্বের। নবীনপত্র-এর প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যার (২০০২-০৩) কথা মনে পড়ে যেখানে মুক্তচিন্তক সমন্বয়-সাধক সদ্যপ্রয়াত অন্নদাশঙ্কর রায়কে স্মরণ করা হয়েছিল। অন্নদাশঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ দুটি লেখা (‘ভারতীয় মুসলমান’ এবং ‘সাম্প্রদায়িকতা : তখন ও এখন’) সেখানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। অন্নদাশঙ্কর স্মরণে লিখেছিলেন এই ধারারই চিন্তক সুরজিৎ দাশগুপ্ত, গৌতম নিয়োগী প্রমুখ। লেখক যে ‘পুরো সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের ঐক্য’র প্রয়োজনের কথা এই বইতে উচ্চারণ করেছেন সেই ধারারই তো এঁরা দিশারী। সাম্প্রতিককালে মিলন দত্তের মত লেখকের লেখার কথাও বলতে হবে যাঁরা মুসলমান সমাজ সম্পর্কে অপরিচয়ের গণ্ডি ভাঙতে প্রয়াসী। খাজিম আহমেদ এঁদের সম্পর্কে বইতে একটা অংশ রাখলে পাঠক ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার ধারাকে প্রত্যক্ষ করতে পারতেন।
এই বইয়ের আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের উল্লেখ করা উচিত। সামগ্রিকভাবে ইতিহাসচর্চায় এবং বিশেষভাবে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের উপস্থিতির বিশ্লেষণ তার মধ্যে একটি। ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে রাজনীতির আলোচনাও অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে। লেখক তো শুধু ইতিহাস লেখেন নি, লিখেছেন সমসাময়িক সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ে। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের কাজকর্ম তিনি তাঁর বিশ্লেষণী আতস কাঁচের তলায় ফেলেছেন। তবে ক্ষমতা তো আর শেষ কথা বলে না। শেষ কথা বলে মানুষ। আর মানুষকে আঁধারে পথ দেখান কোনও কোনও ব্যক্তিমানব; তাঁরাই প্রকৃত অর্থে হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা; যেমন প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪)। দোসরা আগস্ট নানান ওয়েবিনারে উদযাপিত হল তাঁর জন্মদিন। তিনি বলেছিলেন “আমি কেমিস্ট, আমি জাত মানি না”। এই বইতে সঙ্কলিত “আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জীবন অনুশীলন ও শিক্ষাদর্শন” পড়তে পড়তে মনে হয়, যদি আচার্যের মত সবাই কাজের জগতেই নিজের পরিচয় খুঁজতে পারতাম তাহলে হয়তো আর ধর্মীয়, জাতিগত ভেদাভেদজনিত সমস্যাকে অন্তবিহীন বলে মনে হত না!
Social