নিখিল কর্মকার, নদীয়াঃ শান্তিপুরে এই ঢেঁকির ছড়া ও ময়ূরপঙ্খীর গান একটি অতি প্রাচীন সংস্কৃতি এবং এক বিশেষ আকর্ষণ। বড়ো বাজারের ব্রহ্মা পুজো কেন্দ্র করে প্রতি বছর ঢেঁকি ও মৌউর পঙ্খীর গান শান্তিপুরের রাজপথে উপস্থাপন করা হয় শান্তিপুর বড়ো বাজার ব্যাবসায়ী কমিটির পক্ষ থেকে। কিন্তু করোনা আবহের জেরে সমস্ত কিছুই যেন নিয়ম রক্ষার। বাধ্য হয়ে আপনারা দেখলেন ভার্চুয়াল ঢেঁকির অনুষ্ঠান। শান্তিপুরের ভাঙ্গা রাসের ময়ূরপঙ্খীর গান উপস্থাপন করা হয় প্রত্যেক বিগ্রহ পরিবার কর্তৃক । প্রয়াত শান্তিপুর গবেষক, লেখক , সাংবাদিক এবং শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মিহির খাঁ-র লেখনী সূত্রে জানা যায় ১৮৬৩ সালে শান্তিপুর বড়ো বাজারে রামলাল পালের দোকানঘর আগুন লেগে পুড়ে গেলে তারপর থেকেই বাজারে ব্রহ্মা পুজোর প্রচলন ঘটে। তাইতো সেখান থেকেই ধারণা পাওয়া যায় ঢেঁকির গান ও ময়ূরপঙ্খীর ছড়া শতাধিক বছর অতিক্রম করেছে ।
ঢেঁকির ছড়ার বিষয়ের মোট দুটি ভাগ এই ছড়ার প্রথম অংশে থাকে ব্রহ্মা পূজা উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণের আহ্বান এবং ব্রহ্মা পুজোয় কোন কোন অনুষ্ঠান হবে তার আনুষ্ঠানিক বিবরণ । এর দ্বিতীয় অংশে থাকে বর্তমান জীবনধারাকে কেন্দ্র করে ও সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনাগুলি কে নিয়ে কিছু ব্যঙ্গ বিদ্রুপ মূলক গরমাগরম বিষয় নিয়ে রসবোধ সহ তরজা গানের উপস্থাপনা। মূলত এটা শোনার জন্য রাত জেগে মানুষ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গোনে । কিন্তু করোনা আবহে পরস্পর দু’বছর এর ছেদ পড়লো ।
যখন বৈদ্যুতিক আলো , ঝার বাতি, টিভি ও নেট দুনিয়ার রমরমা ছিল না তৎকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের বিনোদনের একমাত্র হাতিয়ার ছিল তরজা গান। এই তরজা গান, ঢেঁকির ছড়া ও ময়ূরপঙ্খীর গানের রচয়িতাদের মধ্যে শান্তিপুরে যাদের নাম শোনা যায় তারা ছিলেন লোকো কবি হাজারিলাল দাস, ডাবরে পাড়ার ভজহরি প্রামাণিক, শান্তিপুর গোপালপুরের অধিবাসী গোপাল শেখ, দাদ্দে পাড়ার পঞ্চানন প্রামাণিক । এরপর দাসু অধিকারী , পার্বতিবালা দাসী এবং এর সাথে শান্তিপুর বৈষ্ণব পাড়ার বাবলু সিংহের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। এদের প্রত্যেকেরই এমন কিছু শিক্ষিত না হলেও কাব্যিক প্রতিভা, বাচনভঙ্গি, রসবোধ, শিল্প সাহিত্য চেতনা এবং তার সাথে সুর তাল লয়ের ছন্দ যথেষ্ট পরিমাণে বিরাজমান ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের আর তেমনভাবে তরজা গানের শিল্পী ও ময়ূরপঙ্খীর গান উপস্থাপন করার শিল্পী তৈরি হলো না শান্তিপুরের মাটিতে।
ঝলমলে আলো, মাইক, পুজো প্রাঙ্গণের মেলা সবটাই গত দু’বছর ধরে স্মৃতি হয়ে রয়েছে। ব্রহ্মা পুজো নিমন্ত্রণ এর উদ্দেশ্যে শান্তিপুরের রাজপথে কাতারে কাতারে লোক অপেক্ষায় থাকতেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, মজার ছলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শোনার জন্য।
বর্তমানে বিষন্ন মনে কর্মহীন গৃহবন্দী সাধারণ মানুষকে কিছুটা আনন্দদানের উদ্দেশ্যে এবং শান্তিপুরের ঐতিহ্য একেবারে বন্ধ না হয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে , দুধের স্বাদ ঘোলে পূরণ করার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। মূল লেখনি রজত প্রামানিক, ব্রহ্মা পুজো কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অতীন্দ্র মন্ডল, বড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক প্রসেনজিৎ সেনের সহযোগিতায়, বহুরূপী জীবন্ত মডেল সংস্থার সদস্যদের অভিনয়ে এদিনের এই বিশেষ নিবেদন।
Social