মৌসুমী বিশ্বাসঃ এই ছবির নেপথ্যের কাজ শুরু হয়েছিল আজ থেকে চার বছর আগে ট্রেনে ২০১৮ সালে দুজনের পরিচয়ের মাধ্যমে। সুব্রত রায় এই ছবির প্রযোজক, উত্তরবঙ্গের এক সনামধন্য ব্যবসায়ী দার্জিলিং মেলে কলকাতা আসছিলেন তার ব্যবসার কাজে। সেই সময় তার ট্রেন এই আলাপ হয় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি আধিকারিক (অফিসার) তন্ময় আচার্য্যের সাথে। তন্ময় নিজে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও একজন থিয়েটার কর্মী ও লেখালেখি মূলত বাংলা সাহিত্যের সিনেমায় ব্যবহারিক ক্ষেত্র গুলিতে তার প্রবল আগ্রহ। এই স্মার্ট ফোনের যুগেও সুব্রত ও তন্ময়ের ট্রেন এর সেই ১০ ঘন্টা সময় কাটে তন্ময়ের লেখা গল্প ও সেই গল্প ঘিরে তার সিনেমা বানানোর স্বপ্ন শুনে। দুজনের ফোন নম্বর বিনিময় হয়৷ ট্রেন কোলকাতায় থামে। দুজন সদ্য পরিচিত মানুষ বন্ধু হয় ও যে যার কাজে কালের নিয়মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এর মাঝেই ২০১৯ তে আসে মহামারী করোনা। সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায় মাসের পর মাস। তন্ময়ের অফিস মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তৈরি হয় পরিবার ও অফিসের চাপের বাইরে ফাঁকা সময়। তন্ময়ের কলম এই সময় লিখে ফেলে টানটান উত্তেজনায় ভরপুর ক্রাইম থ্রিলার এর ওপর তিন তিনটে নতুন গল্প। আর তার মাঝেই ২০২০ র এপ্রিল মাসের এক রাতে তন্ময়ের ফোন এ কল আসে সুব্রতর। ২০১৮ সালের সেই ট্রেন এর পরিচয়ের পর এই প্রথম তাঁদের কথা। এতদিন পরে হঠাৎ করেই সুব্রতর এই আকশ্মিক ফোন এ তন্ময় অবাক হয়৷ সুব্রত ফোন করে প্রথম এটাই জিজ্ঞেস করে— দাদা তোমার সিনেমা বানানোর স্বপ্ন টা এখনো আছে? লেখালেখি করছ আগের মতো?
তন্ময় প্রবল আগ্রহে সদ্য লেখা তার গল্প গুলির কথা বলে। সেই রাতেই সুব্রত আবার ফোন করে। করোনা কালে ভিডিও কনফারেন্স বিজ্ঞানের এক নতুন আশীর্বাদ। মাঝ রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়৷ তিনটে গল্পই সুব্রত ভিডিও কনফারেন্সে শোনে ও তন্ময় কে বলে দুদিনের মধ্যেই উত্তর বঙ্গ আসতে পারবে কিনা? লক ডাউন এ সুব্রত বাবুর কাজের চাপ কম। সুব্রত বাবুই ছবির প্রযোজনা করতে চান। যদি সম্ভব হয়, তবে এই লক ডাউন এই করতে চান সিনেমার শ্যুটিং। গল্প রেডি। প্রযোজক রেডি। কিন্তু এই ছবি পরিচালনা কে করবেন? আলো, ক্যামেরা, টেকনিক্যাল কারা সামলাবেন? এই প্রবল করোনা পরিস্থিতিতে কারা অভিনয় করতে রাজি হবেন? আদৌ সরকারী অনুমতি পাওয়া যাবে কিনা? কিছুই জানা নেই।
চারদিকে ঘোর লকডাউন। সারা দেশে জুড়ে ট্রেন। কি করে যাবে জানা না থাকলেও তন্ময় কথা দেয় সে যাবে।
মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে একসম্ভাবনাময় অথচ অখ্যাত পরিচালক স্বপন নন্দীর নাম। টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে গত ২২ বছর ধরে যিনি নিজের ছাপ রাখতে চাইছেন, অত্যন্ত যোগ্যতা সম্পন্ন কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে যিনি নিজের যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছেন না। তন্ময়, মুহূর্তের মধ্যে সব ভেবে নিয়ে স্বপন নন্দীকে ফোন করে সব বিস্তারিত ভাবে বলে। নন্দী বাবুও সব শুনে রাজি হয়ে যায় উত্তরবঙ্গ যেতে। রাজ্য সরকারের স্পেশাল বাসে দুদিনের মধ্যে দুজন উত্তরবঙ্গ পৌছায়। সেখানে প্রথম আলোচনা হয় প্রযোজক, লেখক ও ভাবি পরিচালকের। একদিন পরেই ওরা ফিরে আসে। এবার শুরু হয় তন্ময়ের গল্প গুলিকে বেঁধে নন্দী বাবুর স্ক্রিপ্ট লেখার পালা। তার সাথে সিনেমা সংক্রান্ত ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার-এ ছবির নাম রেজিষ্ট্রেশন করানোর কাজ ও স্টার মোশন পিকচার-এর নির্মাণের কাজ। কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়৷ মাত্র দুমাসের সময় কালে প্রি প্রোডাকশন এর সব কাজ শেষ হয়৷ সাথে তৈরি স্ক্রিপ্টও।
এরপর ছিলে অপেক্ষা। আউটডোর শুটিং এর জন্য করোনা কালের ভয়াবহতার মাঝে সরকারি ছাড়পত্রের। টালিগঞ্জ এর ফিল্ম ফেডারেশনের বহু কর্মীরা তখন প্রায় ছয় মাস কাজ না থাকায় অত্যন্ত অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। পরের দিনের পরিবারের মুখে খাবার কি ভাবে তুলে দেবে, সেই নিয়ে সকলেই নিদারুন সমস্যায়। স্টার মোশন পিকচারের খবর এই সময়ে তাঁদের মুখে মুখে। কারণ আগামী দিনে সিনেমা হলে গিয়ে মানুষ সিনেমা দেখবে কিনা, সেই কথা ভেবে কোনও প্রযোজনা সংস্থাই আর নতুন কাজে হাত দিতে চাইছেন না। অথচ এই সংকট কালেই স্টার মোশন পিকচার ভীষণ ভাবে চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে নতুন উদ্যমে নতুন ছবির কাজ শুরু করার। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই জোট কাটলো।
সরকারিভাবে ৩২ জনের ইউনিট নিয়ে আউটডোর শুটিং এর ছাড়পত্র পাওয়া গেলো। গত জন্মাষ্টমীর দিন ১১ আগস্ট শুভ মহরত হল ২০০ বছরের পুরোনো উত্তর কলকাতার অন্যতম হেরিটেজ ভুবন বাড়িতে। এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। এরপর অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শুটিং হল গোর্খা টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর অন্তর্গত দুধিয়া নদী লাগোয়া পাহাড়ে। রোহিনী পাহাড় সংলগ্ন পার্কে, ব্লু মাউন্তেন কান্ট্রি ক্লাব এন্ড রিসর্টে। শুটিং হল সবুজ দ্বিপ, কল্যাণী, মদনপুর, মোসনন্দপুর ও কলকাতায়। ১৫ দিনের শুটিং এ শেষ হল তিনটি ভিন্নধর্মী ক্রাইম থ্রিলার এর সমন্বয়ে “আগন্তুক”-এর শুটিং পর্ব। অভিনয় করলেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা অমিতাভ ভট্টাচার্য, গোরা ধর, সোমা ইন্দু দে, পূজা গাঙ্গুলি, সুমন্ত দাস, কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জি, শান্তনু মুখার্জি ও আরও অনেক কলাকুশলি। তন্ময় আচার্য নিজেও একটি গল্পে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাথে অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর-এর দায়িত্বও সামলেছেন। মূলত যে তিনটি গল্পের আঁধারে আগন্তুক গড়ে উঠেছে, তার একটির নাম দ্য ভায়লিন, একটির নাম যোগসুত্র, একটির নাম দ্য ফ্রুট অফ ইভিল। তন্ময় জানান, তিনটি ভিন্ন সাধের এই ক্রাইম থ্রিলার গুলির মূল তত্ত্ব একটাই— তা হল, লোভের বশবর্তী হয়ে আমরা নিজের জানায় বা অজানায় যে কোনও ভুল কাজ বা পাপ কাজ করলে তার ফল আমাদের জীবনেই আমাদের ভোগ করতে হবে।
হয়তো জীবনে ভালবাসার খোঁজে বা অর্থের পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে, বা ক্ষণিকের কোনও সুখের হাতছানিতে আমরা কোনও ভুল করে ফেলি। সেই ভুল তৎক্ষণাৎ শুধরে না নিলে বা সেই ভুলকে না বুঝলে তার ফল আমাদের এই জীবনেই ভোগ করতে হয়৷
ছবির নির্মাণের কাজ শেষ। পরিচালক স্বপন নন্দী এই ছবি নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই ছবি মানুষের ভালবাসা পাবে। এই ছবির মাধ্যমে যেই কঠিন সময়ে ছবির কলাকুশলিদের তাঁদের কাজের বিনিময়ে সম্মানের সাথে তাঁদের পরিবারের মুখে তাঁরা যে হাসি ফোটাতে পেরেছেন, তার ফল কখনও বৃথা যেতে পারেনা। এতো মানুষের আশীর্বাদ যেই ছবির প্রতিটা পরতে রয়েছে— সেই ছবি অবশ্যই ঈশ্বরের আশীর্বাদ এ দরশকের মন জয় করবে। এই ছবির ক্যামেরা করেছেন বর্তমান সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান সিনেমাটগ্রাফার সৌরভ ব্যানার্জি। ছবিতে সুর দিয়েছেন অনিন্দ্য ব্যানার্জি। সম্পাদনা করেছেন অভিজ্ঞ সম্পাদক অভিজিৎ পোদ্দার।
এছাড়া ও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন নবাগতা শ্রীময়ী সরকার। তিনি একটি গান ও গেয়েছেন। এই ছবিটিতে অন্য দুটি গান গেয়েছেন আলিশা ও অর্ণব ভট্টাচার্য। ছবিটিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন সুদূর রাজস্থান থেকে আগত সোহিনী রায়।
পরিশেষে তন্ময় ও স্বপন নন্দী একই সাথে ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই ছবির প্রযোজক সুব্রত রায়কে। এভাবে যে একটি ট্রেন এর যাত্রায় পরিচয় হওয়া একজন মানুষের প্রতি আস্থা রেখে চার বছর পর সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের প্রতি নিজের আস্থাকে অটুট রেখে সুব্রতবাবু এক অভুতপূর্ব বিশ্বাসনির্ভর কাহিনীর জন্ম দিলেন, তা আজকের দিনে বিরল। আজকের দিনেও যে এমন বিষ্ময়কর ভাবে কিছু মানুষের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ভালবাসার মেলবন্ধনে একটা গোটা সিনেমা তৈরি হয়ে গেলো, অচেনা একজন মানুষের মুখের কথার ওপর ভরসা করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে রাজি হলেন, তা সিনেমা প্রেমী মানুষের জন্য আগামী দিনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।
Social